Breaking News
Home / Breaking News / কবি অনমিত্র স্যানাল এর ” পত্ঝড়”

কবি অনমিত্র স্যানাল এর ” পত্ঝড়”

এবার গদ‍্য.. দেখুন তো..!!

পত্ঝড়

অনমিত্র

২৫/১১/২০২১

হিন্দীতে ‘পতঝড়্’ বেশ একটা মিষ্টি মউতাত্ আনে , আঁটসাঁট অনুভব নিয়ে। বাংলাতে যার প্রতিশব্দ পেতে দেখছি যারপরনাই মুস্কিল !! কিন্তু বাঙালির ছেলে ,হলামই বা ‘হিন্দুস্তানী ’!!বাংলায় তো আর হিন্দি লেখা যায় না বা লেখ্য করে তোলাও যথেষ্ট কুরুচিকর । পাতা ঝরার দিনগুলি বললেই বেশ হবে। জুতসই যুযুৎসু-র প্যাঁচ এর মতো নাই বা হ’লো !!

ফেব্রুয়ারি -র শেষ মানে “ফাগুন লেগেছে বনে বনে” – আর আমাদের মনে তো ফাগুনের ফুলকি বছরভর।

শম্ভু , ইসলাম , লালন ,মথুরা আর আমি বসন্তের পূর্ণ বিহঙ্গ পঞ্চভূজ হয়ে তখন পুকুর পাড়ে শ্যাওড়া গাছ তলা আলো করে বসে আছি !!
নিদাঘ মধ্যাহ্ন !! সামনে হামানদিস্তা ,ফিউজ্ টিউবলাইট,বড় বড় লাটাই আর সুতোর বান্ডিল। ইসলাম… দাদা , কিন্তু কোনো তুঘলকি চাল নেই !! বড় লম্বা লাইটের দু-প্রান্ত ভেঙে ভেতরে জল ঢুকিয়ে পরিস্কার করছিল মথুরা , মনি মাসির ছেলে। আর আমি সুতোর বাণ্ডিল সামনের পুকুরের নীরে নীত করলাম।
“ মথুরা কাঁচ গুলো শম্ভুকে দিয়ে আয় !!! ”-শুনেই বুঝলাম ইসলামিক চাল।
একদিকে তিনটে ইট দিয়ে তৈরি উনুনে সাবু জলে ফুটছে তবে জোলো নয় ক্রমে ক্রমে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। দুলে উঠছে হৃদয় ,বছরের প্রথম অপ্রথাগত মাঞ্জা দেওয়ার অঙ্গীকারে !!
এদের মধ্যে শম্ভু আমার প্রাণোচ্ছল পথপ্রদর্শক , যেন এক প্রবীণ প্রতিভূ ,প্রগলভ নয় মোটেও !! অবিচল ,ধীর। হামানদিস্তায় কাঁচ গুলো শুধুমাত্র এত মিহি হয়ে উঠছে শম্ভুর অসাধারণ অধ্যবসায়ে !! যখন ফুটবল খেলতো,অসাধারণ অনুধাবনে “ দ্য মোষ্ট ডিপেন্ডেবল ” হয়ে উঠেছিল।
আমি নিজে শম্ভু ছাড়া টিম ভাবতে পারতাম না।

আমরা তখন ঘুড়ির তালে বুঁদ। তাল কাটে ইসলাম-এর মা-র চ্যালা কাঠ নিয়ে আগমন দৃশ্যে !!! আমরাও রনে ভঙ্গ দিলাম। রাশি রাশি বার্ণপুর থেকে ধেয়ে আসা ঘুড়ি কেটে আমরা তখন ক্লান্ত !!!
মিথ্যের চাষ করে এসেছি তো, তাই তোড়জোর ফেরার । চামড়া গুটোনোর ভয়।সন্ধ্যে হয়ে আসছে !! শেষ হল মিথ্যের “মিথ”!!

এখন ছেলে মেয়েরা খেলাধূলার সময় পায় না সময়সূচির হেরফেরে তবে হেরাফেরিতে হলফ করে প্রথম সারিতে থাকবে।

আমরা সময় পেলে পড়তাম। কবিতাদি বলতেন বুদ্ধির বৃহস্পতি !!! বর্ণময় শৈশব যখন চরম ঔদাসীন্যে !!বড়োদের ঔদার্যও ছিল তলানিতে। বাবারা ছিলেন চরম বস্তু । ধরা ছোঁয়ার বাইরে । মায়ের সাহচর্য্যই ছিল এক চিলতে আশা,আশীর্বাদ বল্লেও আতিশয্য হয় না !!

গল্প কম !!
উৎসাহ বেশী… বসে থাকলে যা।হয় আর কি…

তবে সবার গ্রহণ এবং গহিন ইচ্ছে যদি উৎকোচ বরাবর আকর্ষণীয় হয় তবে গল্পের হয়রানি না হয় একটু কিঞ্চিৎকর হলোই বা !!

এই জীবন সবে জীবন্ত হতে শুরু করেছে !! কিন্তু শুরুয়াত্ নড়বড়ে ,ভারতের ওপেনিং জুটির মতো কখনো জুতসই নয় বলেই বোধহয় আত্মনির্ভরতার বড় বড়াই !!

সেটা প্রকারান্তরে আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠল বিদ্যুতের সারল্যে, মানসের মানানসই মানসিকতায়, প্রদীপের প্রদীপ্ত উপস্থিতিতে,আর নিখিলের বিলম্বিত লয়ে !!!

আমরা আত্মজের চেয়ে কম ছিলাম না। এরপর অজিত ,বাপী ,মনি , রজত ,ভোলা !! ভুলবার নয় !! ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিলাম আমরা, আশ মিটিয়ে , ঘুম উড়িয়ে ।
বসন্তের আসমানী ঘুড়ি গ্রীষ্মে নিতান্তই নিস্ফল !!
আস্ফালন হতে না হতেই গ্রীষ্মের ছুটি আর নিয়ম করে সকালে লাট্টু ,গুলিডাণ্ডা , সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে বানানো তাস আর নাহলে গরম থেকে বাঁচতে বিশাল বিশাল ইঁদারায় অবগাহন।জীবনের মধ‍্যাহ্ন আসতে না আসতেই বদলে গেল প্রেক্ষাপট..

নিশ্চিহ্ন নীরবতা তখন ব্রাত্য !!

মেঘ মেদুর দিনে গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের অনলস দুপুর যখন থমকে দাঁড়াতো , আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নতুন উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ হতাম ,গুলি খেলার মাতুনিতে।

অজস্র গুলির মধ্যে দিয়ে স্বপনদার স্বপ্নিল বিচরণ…এবং নিমেষে গুলিদের অন্তর্ধান…যেন ম‍্যাজিক…এবং স্বপনদার নির্বিকার অভিব্যক্তি। আমাদের অজ্ঞতার সমাধান স্বপনদা নিজেই করেছিল।

সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম !! ম্যাজিসিয়ানের ভঙ্গিতে প্লাস্টিকের চটি উল্টো দিকে ঘোরাতেই দেখলাম তলায় অনেক গুলো করে চৌকো গর্ত । একবার চৌতাল ঠুকলেই দশজন মার্বেল অন্তর্হিত হবেই। দারুন দাদা ম্যাজিক্ -ই বটে !!!!

একটু নিখিল নিবেদন না করলে নীরস হবে এই হলফনামা ,হলফ করে বলতে পারি। জন্ম লগ্নস্থ গোঁয়ার ,ইন্দ্রনাথের ইন্ধনিক প্রবৃত্তি আর দুরন্ত সাহস !!! সব মিলিয়ে সে এক মিলনান্তক গরমিল । বাবার কাছে মার খাওয়া তার দীর্ঘ সাধনার দৈনন্দিন তারিফ ,তৎপরতার ফসলও বলা যায় !!!

গ্রীষ্মের ছুটির বিকেল মানে নিখিলকে পাওয়া যাবে চারটেয়,মাঠের ধারে ছাতিমতলায় ,যাবতীয় দুর্বুদ্ধির পসরা নিয়ে। একেবারে নিয়োজিত প্রাণ ।

“ যা দেখিলাম জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। ”

নিখিল মধ্যমণি হয়ে বসে,সামনে জনা তিনেক কুকুর আর একটু এগিয়ে ক্লাবের লাগোয়া পুকুর। লাগসই একখানা দৃশ্য বটে । হাতে খানকয়েক বিস্কুট নিয়ে সারমেয় আতিথেয়তা সারছে।
আমাকে দেখে কপট হাসল !!! সারমেয়কুল তখন নিখিলের তখ্ত আলো করে।

হঠাৎ একটা প্রমাণ সাইজের কুকুরের পেছনের পা দুটো গোছা করে ধরে মাথার ওপর বনবন ঘোরাতে লাগলো হ্যামার থ্রোয়ারের মতো , প্রচণ্ড গতি তুলে যখন ছুঁড়ল ,প্রায় তিরিশ মিটার শূন্যে ভ্রমণ করে পড়লো গিয়ে জলে। তিনজনের ভাগ্য রেখা ছিল একই সুতোই লেখা । এরকম কদর কদিন চলার পর সারমেয়কুল নিখিলকে দেখলে নিখুঁত ভঙ্গীতে পিঠটান দিত। ত্রিসীমানা ছাড়িয়ে ,বোধহয় ত্রিলোকে।

গুরু তুমি লা-জবাব !!

আমার প্রথম শৈশবের অনেকখানি জুড়ে নিখিল । ছোটোবেলা থেকেই দুর্ধর্ষ !! ক্লাসঘর তাকে কোনো ক্লাসে ফেলতে পারবে না।

অনেক ছোটোবেলায় প্রান্ত পল্লীর প্রান্তরে ঘুরে কাঁকড়া বিছে ,চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা ধরে আনতো অবলীলায়। একটা প্রমাণ সাইজের ধেয়ে আসা গোখরোকে শাবলের এক ধাক্কায়ই সাবাড় করেছিল , “ ডু অর ডাই ”সিচুয়েশনে !!

সমসাময়িক একটা ঘটনা ,আর একটু হলে ঘনঘটাই হতো। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ । সুতরাং কালিপুজোর মেলা সরগরম এবং সার্কাস । বাঘ ,সিংঘের ঝরঝরে খাঁচা আর নিখিলের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ !!! কিন্ত কিনারা করতে পারিনি এর ব্যপ্তি।

বিকেল পাঁচটা !! মায়ের সাথে পাঞ্জা কষছি , কি ফিকিরে ফেরার হওয়া যায়,ওমনি দেবতার দান !! দেবদূত হয়ে নিখিলের আবির্ভাব । আবেগে আপ্লুত আমি !!

হাতে দুটো লম্বা কঞ্চি । “কি হবে?”

“মেলার মাঠে আয়। ” মেলা কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম । বাঘ সিংহের খাঁচা মেলার উল্টো দিকে মাদার টেরেসা ক্লাবের মাঠের জঙ্গুলে জলায়। আমার হাতে একটা কঞ্চি ধরিয়ে দিতেই আমি ধেড়িয়ে গেলাম। “আমার সাথে আয় ” নির্দেশ ভেসে এল নির্দেশিকার মতো ।

একেবারে বাঘের খাঁচার সামনে!! মাইরি বলছি আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া !! “এইবার বাঘের পেটে কঞ্চি দিয়ে খোঁচা !!!!!”
প্রভাতনন্দনের প্রখর ঘোষণা !!! নিজে খোঁচায়..”খুব বাঘ হয়েছো না..? এবার।ঠ‍্যালা সামলাও..” কে কার ঠ‍্যালা সামলায়..!!

এই একজনকে এখনও সমাদর করি তার প্রবল প্রাণরস আর দুরূহ স্পৃহার প্রাণপণ সমাহারে !!!

কিন্তু বারংবার খোঁচায় এই লাঙ্গুল বিশিষ্ট প্রাণীকুল এতই চঞ্চল হয়ে উঠল যে সেই উত্তলতা ওই ঝরঝরে খাঁচার পক্ষে যে বেশীক্ষণ ধরে রাখা সম্ভব নই তা বিলক্ষণ বুঝেছিলাম। সার্কাসের লোকেরা বেরিয়ে এসে পরম পর্ব সুরক্ষিত না করলে ওই খাঁচা খাক হয়ে নিখিলভুবন সাফ হয়ে যেত হাতসাফাই -এর মতো ।

আজ এতবছর পরে জীবন এমন আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছে যে অমিতাভিও স্টাইলে মাণ্ডুয়ার জন্য প্রাণটা হাহাকার করে উঠছে !! ছবি বিশ্বাসের মতো বলতে ইচ্ছে করছে “ ফিরিয়ে দাও আমার পঁচিশটা বছর !!!”

আমার হিন্দুস্তানী শৈশব !!!!!!!!!!!

Powered by themekiller.com