কবিতাঃ ছায়ানীড়
সা।ল।মা।ড।লি।
০৫.১০.২০২১
মরচেপড়া লোহার ফটক দিয়ে ঢুকে খানিকটা উঠোন পেরুলে ছোট্ট দোতলা বাড়ি।
ফটকের উপর ক্ষয়ে যাওয়া আবছা লেখা “ছায়ানীড়”।
গৃহপ্রবেশ দরজায় কারুকাজ খচিত গজারী কাঠের চৌকাঠে খোদাই করে লেখা “এলাহী ভরসা”।
বাড়িটি শতবর্ষীয়।
চুনকাম খসে পড়েছে,ফাটল ধরেছে মেলা।
শতায়ু পাওয়া জাম,জারুল,কড়ুই,তেঁতুলগাছ
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির চারিপাশ ।
তিন দশক ধরে দোতলায় দক্ষিণের ঘরটিতে আমার বসবাস।
এই ঘরটিতেই চোখ মেলে প্রথম দেখেছিলেম উনাকে,
বুকভরা হাসি- কান্না,খুনসুটি,রাগ-অভিমান নিয়ে
খুব করে ভালোবেসেছিলেম তাকে।
বলতে গেলে তার ভালোবাসায় ছিলেম অন্ধ,
এতো ভালোবাসার বাঁধন কখন খসে গেল টের
পেলাম না মোটেই,
অথচ সদাই খুঁজে পাই তার গায়ের ঝাঁজালো গন্ধ।
এখানেই ছেলেপুলে নিয়ে ভরা সংসারের স্বপ্ন খোদাই করা দারুশিল্পের পরতে পরতে লেখা আছে সিলভার হরফে।
স্বপ্নগুলি মৃগতৃষ্ণা হয়ে লেপ্টে আছে দেয়ালে দেয়ালে,
বাড়ির প্রতিটি ইট,কাঠ,দেয়াল,তৈজসপত্র আমাকে চেনে,আমার সাথে কথা বলে তরফে তরফে।
বাড়ির বাহির দেয়ালে শ্যাওলা ধরেছে বহুদিন,
পরজীবী লতাগুল্মের সাথে একটা বটগাছ শিকড় বাকড় ছড়িয়ে বেশ জমিয়ে বসেছে বেদুইনের মতো।
সেখানে আবার বাসা বেঁধেছে শালিক আর টুনটুনি।
দম্পতি পাখিদের কোলাহলে রোজকার ঘুম ভাঙ্গে আমার,
স্নানের ঘরে বসে ওদের সুখ-দুঃখের কথা শুনি।
একদা কোলাহল-কোন্দলে মুখরিত বাড়িটি আজ একেবারেই শান্ত,মৃতপ্রায়।
একে একে বাড়ি ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে স্বজনেরা,
আমি একা প্রেতআত্মার মত নিশাচর হয়ে পড়ে আছি।
আর আমার উনি বিয়ের দু’বছর পর আশ্বিনের এক ভরা পূর্নিমায় বলে গেল,
“একটু অপেক্ষা করো তোমার জন্য মিষ্টি পান সাজিয়ে আনছি চমনবাহার দিয়ে”
আসছি বলে সেই-যে গেল….
জারুলের গন্ধে বিভোর হয়ে জামের রসে মুখ রাঙ্গাই প্রতিবার,
কিন্তু প্রতিক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না ।
রোগে শোকে ভাঙাশরীর,ভাঙামন নিয়ে দক্ষিণের জানালায় ঠায় বসে থাকি দূর পথপানে চেয়ে।
মাঝে মাঝে আমার চোখ আটকে থাকে দেয়ালে লটকানো দাদীশাশুড়ির সূচিকর্মে,”সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে”।
অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে যায় বুক চিরে,
আমার একাকীত্বের সংগী টিকটিকি টিকটিক শব্দ করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে।
ফলের ঝুড়ি থেকে লাল পিঁপড়ের সারি লম্বা মিছিল করে ঘরের পূর্ব দেয়ালে গিয়ে সমাবেশ করে দীর্ঘশ্বাস বন্ধের।
আমার যাপিত জীবনের গল্প ভাগাভাগি করে নেয় কুনোব্যাঙ,আরশোলা,মাকরাসা আর বেঁজি।
প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা করে বেঁচে থাকাটা আনন্দের।
ঘরের মেঝেতে একটা টেরাকোটার কারুকাজ খচিত পালংক বাড়ির জৌলুসতা বহন করছে।
প্রায় দুশো বছর আগে এই পালংকে সংসার বেঁধে ছিলেন এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেই পাংলকে শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সিলিংয়ের দিকে।
নিচতলার বৈঠকখানায় দাদাশ্বশুরের হেলান দেয়া আরাম কেদারার পাশে শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর নান্দনিক পিদিমের একচিলতে আলো বাড়িটি করে রাখে রহস্যময়।
জৌলুসতা বলতে এটুকুই আছে এখনো।
সকাল হতেই অতি যত্নে সব কিছুর উপর ছুঁয়ে দেই আমার রুগ্ন হাতের পরশ গভীর মমতায়।
সবই আমি যক্ষের ধনের মত আগলে আছি,
কেন জানেন?
যদি উনি চমনবাহার দিয়ে পান সাজিয়ে নিয়ে আসে আমার জন্যে!!