আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফরিদগঞ্জ: ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি (পশ্চিম) ইউনিয়ন ভূমি অফিস। অফিস ভবনে দু’টি কক্ষ। দু’দিন সেখানে গিয়ে দেখা যায় দু’কক্ষে দু’জন বসে কাজ করছেন। একজন নজরুল ইসলাম। অপরজন বিমল দাস। খারিজের আবেদন, খতিয়ান-দাখিলা সরবরাহ, খাজনা ও ফিস গ্রহণসহ যাবতীয় কাজ করছেন বিমল দাস। নজরুল ইসলাম প্রায়শঃ অফিসে যান সকাল ১১ ঘটিকার পর। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বিমল দাসকে ডেকে নেন। বিমল যাবতীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করেন। নজরুল ইসলাম তাতে চোখ বুলান। বিমলের সঙ্গে একান্তে আলাপ আলোচনার পর স্বাক্ষর করেন। বিমল দাসের নিয়মিত অপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে নেবা গ্রহিতাদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করা। টাকার অংক নিতান্ত কম নয়। সব মিলিয়ে কখনও তা লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিসের টাকা গ্রহণ করছেন- এমন প্রশ্নে বিমল দাস অকপটে সব বিষয় স্বীকার করেন। সেবা গ্রহণের জন্য অফিসে গিয়েছেন এমন একজন কামরুল ইসলাম। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় বিমল দাসকে চেনেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, বিমল এই ভূমি অফিসের কর্মকর্তা! ঘটনাটি ইউএনও’র কানে দেয়া হয়েছিলো- বলেছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। আমি জানি না- বলেছেন ইউএনও।
সরেজমিন জানা গেছে, ৬নং গুপ্টি (পশ্চিম) ইউনিয়ন ভূমি অফিস স্থানীয় খাজুরিয়া বাজারের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। ওই অফিসে প্রায় সাড়ে তিন বছর যাবত ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করছেন নজরুল ইসলাম। তিনি ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ খ্রিঃ-এ সেখানে যোগদান করেন। সরকারী ও ভিপি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, নথি সংরক্ষণ, ভূমি উন্নয়ন করা আদায়, বিধি মোতাবেক ভূমি মালিকের অনুকুলে খারিজি খতিয়ানের আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা ভূমি অফিসে প্রতিবেদন পেশ, দাখিলা প্রদান, হাটবাজার ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট কর্ম সম্পাদন তার দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিধি মোতাবেক প্রস্তুত ও প্রাপ্ত হয়- এমনতর প্রতিটি খারিজি খতিয়ানের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সরকারী ফিস সর্ব সাকুল্যে ১১ শত ৭০ টাকা জমা দিতে হয়। ভূক্তভোগী নাগরিকদের কাছে জানা গেছে, সরকারের এ নির্দেশনা মানছেন না নজরুল ইসলাম। খারিজি খতিয়ানের প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবী ও আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। যোগদানের পর হতে ওই অফিসে যাবতীয় কাজ করতেন নজরুল ইসলাম। তবে, প্রায় ১০ মাস পূর্ব হতে সেখানে নতুন একজন স্টাফ নিয়োগ পেয়েছেন। তার নাম বিমল চন্দ্র দাস। পিতার নাম পরিমল চন্দ্র দাস। বসবাস করেন একই ইউনিয়নের লাউতলী গ্রামে। এ ১০ মাস যাবত অফিসের যাবতীয় কাজ করেন বিমল বিমল চন্দ্র দাস। ভূমি অফিসের দুটি কক্ষের বামদিকের কক্ষে বসেন নজরুল ইসলাম। অত্র ভূমি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ বালাম বহি, নথিপত্র, নকশা ইত্যাদি রাখা স্টিল আলমিরা, র্যাক, চেয়ার-টেবিল সাজানো ডানদিকের অপর কক্ষে বসেন বিমল চন্দ্র দাস। নজরুল ইসলাম রূপসা (উত্তর) ইউনিয়নের অফিসে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করার কারণে অত্র অফিসে তিনদিনের বেশি বসতে পারেন না। কিন্তু, বিমল চন্দ্র দাস প্রায় প্রতিদিনই অফিস খোলেন ও বসেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, দুটি কক্ষেই স্টিল আলমিরা ও র্যাকে ভূমি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ বালাম ও নথিপত্র রয়েছে। ডান পাশের কক্ষে বসেন বিমল চন্দ্র দাস। ওই কক্ষে বসে তিনি সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে খারিজি খতিয়ান ও দাখিলা রশিদ এর আবেদনের জন্য কাগজপত্র গ্রহণ করেন। তা গ্রহণের সময় ভূমির গুরুত্ব ও পরিমাণ ভেদে বিভিন্ন অংকের টাকার চুক্তি ও আংশিক বা চুক্তি মোতাবেক সম্পূর্ণ টাকা গ্রহণ করেন। টাকার অংক সাত থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিন জানা গেছে, খারিজি খতিয়ানের জন্য হামছাপুর গ্রামের নয়চন্দ বাড়ির আবদুর রব মাস্টার এর ছেলে জাকির মিজি’র কাছ থেকে ২০ টাকা, হামছাপুর গ্রামের শাহজাহান দেওয়ান এর ছেলে সাহাব উদ্দিন দেওয়ান নোবেল এর কাছ থেকে সাত হাজার টাকা, খাজুরিয়া গ্রামের নানু ভুইয়া’র ছেলে মনির হোসেন এর কাছ থেকে তিনটি খারিজে ৩০ হাজার টাকা, হামছাপুর গ্রামের মৃত শহীদ উল্লা দেওয়ান’র ছেলে সাইফ উল্লা খালেক বাবু দেওয়ান এর কাছ থেকে সাত হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। হামছাপুর গ্রামের আবদুল লতিফ পাটওয়ারীর নামে দাখিলার জন্য নিয়েছে আট হাজার পাঁচ শত টাকা নেওয়া হয়েছে। যদিও, দাখিলার রশিদে উল্লেখ করেছেন ৮৮০ টাকা। হুগলী গ্রামের মৃত মজিবুর রহমান’র ছেলে তাজুল ইসলাম হাজী’র কাছ থেকে দাখিলার জন্য ১০ হাজার টাকা চেয়ে সাত হাজার টাকা নিয়েছেন। প্রায় দুই মাস পর ওই টাকা ফেরত দিয়েছেন। তাকে টাকা ফেরত দেওয়া ও দাখিলা কেনো হয়নি তিনি জানেন না।
উল্লেখিত নাগরিকদের সঙ্গে খারিজি খতিয়ান, দাখিলা রশিদের জন্য টাকার চুক্তি ও গ্রহণ করেছেন বিমল চন্দ্র দাস। নজরুল ইসলাম অনেক সময় সকাল ১১ ঘটিকায় অফিসে প্রবেশ ও বিকাল চার/পাঁচ ঘটিকা নাগাদ প্রস্থান করেন। কিন্তু, বিমল চন্দ্র দাস সকাল আট ঘটিকায় অফিসের দরজা জানালা খুলে রাত ১০ ঘটিকা পর্যন্ত অফিস করেন। এ সময় নিয়মিত বিমল দাস অফিসের বালাম ও রেকর্ডপত্র ঘাটাঘাটি করেছেন। অফিসের সব কিছু তার নখ দর্পণে। এ সময়ে, আগত লোকজনের সমস্যা শুনে পরামর্শ, আলাপ ও কাজের চুক্তি করেন- বলেছেন ভূক্তভোগীরা। এ সবের মধ্যে বিভিন্ন মৌজার ভূমির লিজ বিষয়ও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
প্রশ্ন করলে এলাকার নাগরিকগণ বলেছেন, তারা জানতেন বিমল চন্দ্র দাস অত্র অফিসের কর্মকর্তা। কিন্তু, কিছুদিন যাবত নানান জনের কাছ শোনা যাচ্ছে তিনি সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নন। লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই অফিসে গিয়ে বিমল চন্দ্র দাসকে একজন সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীর মতই অফিস করতে দেখা গেছে। প্রশ্ন করলে তিনি অকপটে বলেন, আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন নজরুল স্যার। প্রায় ১০ মাস এ অফিসে কাজ করছেন। বলেন, তিনি সব কাজ বোঝেন করছেন। বিভিন্ন অংকের টাকা দিয়েছেন- এমন অভিযোগকারী লোকজনের নাম উল্লেখ করে জানতে চাইলে তিনি টাকা গ্রহণের তথ্য সরল স্বীকারোক্তি দেন। বলেন, নজরুল স্যারের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তিনি বিভিন্ন অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন ও সম্পূর্ণ টাকা নজরুল ইসলামের হাতে হস্তান্তর করেছেন। বিনিময়ে আপনি কি পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি দৈনিক সামান্য কিছু হাজিরা পাই।
অপরদিকে, নজরুল ইসলাম দাবী করেছেন বিমলের হাতে গৃহীত টাকা তিনি কখনই নেননি। ওই টাকা কে নিয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি জানি না। অত্র অফিসে যাতায়াত করতেন- এমন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে নজরুল ইসলামের নির্দেশনা ছাড়া বিমল অফিসে বসেছেন, টাকা নিয়েছেন ও সকল প্রকার কাগজপত্র আদান-প্রদান করেছেন কিভাবে।
সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেছেন, আমি প্রায় দেড় মাস আগে ইউএনও’কে মৌখিক ও লিখিতভাবে ঘটনা জানিয়েছিলাম।
এ ব্যপারে জানার জন্য মুঠোফোনে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজিজুন নাহারকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাছলিমুন নেছাকে মুঠোফোনে কল দিয়ে বিমল চন্দ্র দাস এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, সমস্যা উল্লেখ করে এ্যাপলিকেশন দেন। “আমি একজন রিপোর্টার”- কিভাবে এ্যাপলিকেশন দেবো। এমন প্রশ্নের পর তিনি বলেন, ডাটা এন্ট্রির জন্য কিছু সংখ্যক লোক চুক্তি ভিত্তিক নেওয়া হয়েছিলো। তবে, আরও আগে তাদের ডিসমিস করা হয়েছে। বিমল এর বিষয়ে আমি জানি না। এ্যাপলিকেশন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।