Breaking News

রাজশাহীতে পৌনে সাত লাখ খেজুর গাছ থেকে ৮ হাজার টন গুড়

রাজশাহী প্রতিনিধিঃ
খেজুরের গুড়ের কেনাবেচায় জমজমাট হয়ে উঠেছে রাজশাহীতে অর্থনীতি। জেলার পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার শীতের মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে খেজুর গুড় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহীতে খেজুর গাছের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। এসব গাছ থেকে প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ৮ হাজার টন গুড় উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ আছে চারঘাট উপজেলায়। এখানে গাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৯৬ হাজার। বাঘা উপজেলায় খেজুর গাছ রয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার। আর পুঠিয়া উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা ৮৫ হাজার।

শীত এলেই এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। গুড় তৈরিতে এই অঞ্চলের পুরুষদের সঙ্গে কাজ করেন নারীরা। গুড় তৈরির পর পুঠিয়ার বানেশ্বর, ঝলমলিয়া আর বাঘা সদরে নিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন গাছিরা। এই গুড় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। ঢাকা থেকে গুড় বিদেশেও পাঠানো হয়। সেই সূত্রে আসে বৈদেশিক মুদ্রা।

পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে গুড় কিনতে আসা বরিশালের আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রতি কেজি ৬০ টাকা দরে ৪০ মণ গুড় কিনেছেন তিনি। বরিশালে এই গুড় ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
গুড় বিক্রেতা মহসিন আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেও ৬৫ টাকা দরে গুড় বিক্রি করেছি। তবে এখন উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দাম একটু কমেছে।’
পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটের পাইকারি গুড়ের আড়ত জয় ট্রেডার্সের মালিক সুমন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সপ্তাহের দু’দিন এখানে হাট বসে। প্রতি হাটে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ১৫০ টন গুড় বেচাকেনা হয়। এই গুড় দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। ঢাকার আড়ত থেকে গুড় কিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশেও পাঠায়। ভারতের কলকাতা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার প্রবাসী বাঙালিদের কাছে খেজুর গুড়ের চাহিদা অনেক।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় দুটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নে ৩০ হাজার ৩৮৯ জন কৃষক পরিবার রয়েছে। খেজুর বাগান রয়েছে চার হাজার। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনা মিলিয়ে দেড় লক্ষাধিক খেজুর গাছ আছে। একজন গাছি প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে রস সংগ্রহে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চার হাজার গাছির ব্যস্ত সময় কাটছে। প্রতি মৌসুমে খেজুর গাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। একেকজন কৃষক গাছের সংখ্যা অনুপাতে গাছি নিয়োগ করেন। তারা মৌসুম জুড়ে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকেন।
পুঠিয়ার জাইগিরপাড়া গ্রামের গাছি ফিরোজ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার নিজের একটি গাছও নেই। প্রতি মৌসুমে ১৭৫ টাকার বিনিময়ে অন্য ব্যক্তির গাছ থেকে রস নামানোর অনুমতি নেন তিনি। প্রায় ১২০টি গাছের রস থেকে তার বাড়িতে প্রতিদিন প্রায় ২৫ কেজি গুড় তৈরি হয়। গুড় তৈরির জন্য জ্বালানি ও সামান্য কিছু কেমিক্যালের খরচ বাদ দিলেও ভালো লাভ হয়। শুধু শীত মৌসুমে এভাবে কাজ করলেও তার পুরো বছরের আয়-রোজগার হয়ে যায়।
উপজেলার আমের যেমন দেশজুড়ে খ্যাতি, তেমনই সুমিষ্ট খেজুর গুড়ের খ্যাতিও রয়েছে। উপজেলায় গুড়ের প্রধান হাট বাঘা ও আড়ানি হাট। এরপর রয়েছে মনিগ্রাম ও দীঘাসহ অন্যান্য হাট। সপ্তাহে রবি ও বৃহস্পতিবার বাঘার হাট বসে। এখানেই সবচেয়ে বেশি গুড় বেচাকেনা হয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদু। শীতের নানান খাবার তৈরিতে এর জুড়ি নেই। এজন্য রাজশাহীর গুড় দেশ-বিদেশে পাঠানো হয়। এবার গুড়ের ভালো দাম পাচ্ছেন গাছিরা। ফলে জেলার পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন চাঙাভাব বিরাজ করছে।’

উপজেলার বাঘা ও আড়ানি পৌরসভা ছাড়াও বাজুবাঘা, গড়গড়ি, পাকুড়িয়া, মনিগ্রাম, বাউসা ও চকরাজাপুর ইউনিয়নের অন্যান্য হাটেও কম-বেশি গুড় বেচাকেনা হয়। তবে বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেকেই বাঘার হাটে গুড় বিক্রি করতে আসেন। বাঘার হাটে রবিবার প্রতি কেজি খেজুর গুড় ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। মৌসুমের একেবারে শুরুতে প্রতি কেজি গুড় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে বেশি দামে গুড় বিক্রি হলেও ভরা মৌসুমে দাম কিছুটা কমে যায়।
বাঘা বাজারের ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক বলেন, ‘এবারের শীত মৌসুমে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হবে। এখান থেকে উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ কোটি টাকা আয় করবেন।’
বাঘা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা সামিমুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি হিসাবে এবারের মৌসুমে খেজুর গুড় থেকে সাড়ে ২০ কোটি টাকা আয় হবে। উপজেলার ৩৫ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গুড় উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া হলে এই শিল্পকে আরও লাভজনক করা সম্ভব। তখন বিদেশেও গুড় রফতানি করা যেতে পারে। এছাড়া গুড় থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া সম্ভব।’

Powered by themekiller.com