আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফরিদগঞ্জ:
হাসপাতালের রেকর্র্ডে আছে বিষপান। প্রচার করা হয়েছে স্ট্রোক। মরদেহ নিয়ে লুকোচুরি করা হয়েছে। করা হয়নি পোস্টমর্টেম। বিষপানের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। রহস্যজনক আচরণের সঙ্গে জড়িয়েছেন বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও জনপ্রতিনিধি। আত্মহননকারীর নাম জান্নাত বেগম। তিনি ফরিদগঞ্জ উপজেলার চরদুঃখিয়া (পঃ) ইউনিয়নের বিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে সংবাদকর্মীকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেছেন শিক্ষার্থীর চাচা লোকমান। কেন অমন রহস্যজনক আচরণ- এলাকাবাসী ও শিক্ষক কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। তারা বলেছেন, তথ্য গোপনকারী বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও জনপ্রতিনিধিকে আইনের আওতায় নিলেই বের হয়ে আসবে প্রকৃত ঘটনা। ১৭ই অক্টোবর ঘটনা ঘটেছে উপজেলার চরদুঃখিয়া (পঃ) ইউনিয়নের চরদুঃখিয়া নমুদ্দি গাজী বাড়িতে।
সরেজমিন জানা গেছে, গ্রামের নমুদ্দি গাজী বাড়ির প্রবাসী ইসমাইল হোসেন এর কন্যা জান্নাত। ১৭ই অক্টোবর সন্ধ্যার আগে এ্যাম্বুলেন্সযোগে তার মরদেহ সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেন তার মা শিল্পী (৩৫), বোন রাবেয়া (২৮), বাবা নজির মোল্লা (৬২)। খবর শুনে আশপাশের লোকজন, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ওয়ার্ড মেম্বার রফিক প্রমুখ নারী পুরুষ, শিশু ছুটে যান। লোকজনের প্রশ্নের জবাবে বলা হয় জান্নাত স্ট্রোক করে মারা গেছে। সবাই তা বিশ্বাস করেন।
কিন্তু, মরদেহ দাফনে বিলম্ব করা ও জান্নাতের মায়ের মামা কালু ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই সন্ধ্যার পর থানায় গিয়ে দাফনের অনুমতির তথ্য ছড়িয়ে যাওয়ার পর বিপত্তি বাধে। প্রশ্নের উদ্রেক হয় অসুস্থ হয়ে মারা গেলে থানার অনুমতি লাগবে কেনো। পরে অজ্ঞাত অনুমতি আসার পর রাত আনুমানিক ১১ ঘটিকায় তাকে দাফন করা হয় পৈত্রিক কবরস্থানে। কিন্তু, এলাকায় শুরু হয় নানা গুঞ্জন। ১৮ই অক্টোবর সন্ধ্যায় ওই খবর পৌঁছে সংবাদকর্মীদের কাছে।
১৯-এ অক্টোবর জান্নাতদের বসত ঘরে গেলে দরজা খুলে দেন তার বাবা ইসমাইল হোসেন (৩৮)। তিনি ১৮ই অক্টোবর প্রবাস থেকে বাড়ি ফিরেছেন। ওই সময় তিনি, তার বড় ভাই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে কর্মরত লোকমান হোসেন (৫০), জান্নাতের মা শিল্পীর মামা কালু (৫২)সহ কয়েকজন ব্যক্তি ঘরের একটি কক্ষে বসে আলোচনা করছিলেন। পরিচয় দিয়ে জান্নাতের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ইসমাইল জানান, মেয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগেও আমি তার সাথে কথা বলেছি। তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ্য ছিল।
জান্নাতের মা শিল্পী বলেন, সে কয়েকদিন আগে ঘুরে পরে যায়। বাড়ির সামনের ফার্মেসী মালিক আনোয়ার বলেছে তার প্রেসার নাই, তাকে ডাক্তার দেখান। শুক্রবার তাকে নিয়ে যাই চাঁদপুর। সেখানে বেলা দেড় ঘটিকায় ডাক্তার দেখাই। জানতে চাইলে তিনি হাসপাতাল বা চেম্বারের নাম বলতে পারেননি। বাড়িতে উপস্থিত শিল্পীর ছোট বোন রাবেয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জান্নাত স্ট্রোক করে মারা গেছে। রায়পুর কোন হাসপাতালে গেছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি না।
সে ঘরে কথা বলার সময় অতর্কিতে ক্ষেপে ওঠেন জান্নাতের চাচা লোকমান হোসেন। “আপনারা কি পাইছেন। ঘর থেকে বের হন। এই এদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দে” বলে তেড়ে আসেন ও মারতে উদ্যত হন। “মারলে, মারেন ভাই। আপনাদের ঘরে মারতে চাইলে মার খাবো। কিন্তু, আমার অরাধ কি জানতে পারি”। এমন প্রশ্নে তিনি কয়েকবার একই আচরণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি গালাগাল করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যান। ওই সময় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার রফিকুল ইসলাম, প্রতিবেশী সাবুল্লা দেওয়ান, কালুসহ অন্যরা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু, কেউ লোকমানকে নিবৃত্ত করেননি। কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে তারা কয়েকজন এ প্রতিনিধিকে টাকা শেধে রিপোর্ট বন্ধ ও ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
কয়েকদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মরদহে নেয়া হয় পার্শ্ববর্তী রায়পুর উপজেলার চরআবাবিল (দঃ) ইউনিয়নের গাইয়ারচর গ্রামের নজির মোল্লা (৬২)’র বাড়ি থেকে। নজির মোল্লা জান্নাতের নানা। ১৭ তারিখ সকালে মা শিল্পী অজ্ঞাত কারণে জান্নাতকে সেখানে নেয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে দুপুরে একটি অটোরিক্সায় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে। জান্নাতের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে রেফার করেন। একটি এ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর জান্নাত নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন, চালক বলেন জান্নাত মারা গেছে। এরপর, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গাইয়ারচর গ্রামের নানা বাড়িতে। সেখানে, বেলা আড়াই ঘটিকা নাগাদ উঠোনে তার মরদেহ রাখা হয়। আশপাশের নারী-পুরুষ, শিশুসহ লোকজন নজির মোল্লার বাড়ি যান। তাদের জানানো হয় জান্নাত স্ট্রোক করে মারা গেছে। অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে একই এ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা নাগাদ মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদগঞ্জ উপজেলার চরদুঃখিয়া (পঃ) ইউনিয়নের চরদুঃখিয়া গ্রামের নমুদ্দি বাড়িতে।
২০-এ অক্টোবর বিকালে গাইয়ারচর নজির মোল্লার বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিলে লোকজন জানান নজির মোল্লা জমিতে কাজ করছেন। ওই সময় বাড়ির ভেতর গিয়ে নজির মোল্লার ছেলের বউ, বেয়াইন ও একজন শিশুকে দেখা যায়। জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা খবর পেয়ে এসেছি। কি খবর। জবাবে বলেন, স্ট্রোক করে জান্নাতের মৃত্যুর খবর। তাদের নানাভাবে প্রশ্ন করার পরও একই কথা বলেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফেরেন নজির মোল্লা। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন “জান্নাত কোথায়, কিভাবে মারা গেছে আমি জানি না”। “আপনার বাড়ি থেকে অসুস্থ জান্নাতকে রায়পুর নেওয়া হয়। মারা যাওয়ার পর পুনরায় এখানে আনা হয়”- এ তথ্য জানানোর পর তিনি একইভাবে বলেন, “আমি জানি না”।
যদিও, নজির মোল্লার প্রতিবেশি ৮ম শ্রেণির মিমি (১৪) ও ১০ম শ্রেণির তানিয়া, তাদের বাবা মাসহ কয়েকজন নারী বলেন, একটি এ্যাম্বুলেন্স গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর তারা বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখেন চাদরে ঢাকা একটি মরদেহ উঠোনে শোয়ানো ছিল। কাউকে মুখ দেখানো হয়নি। জানতে চাইলে শিল্পী বলেছেন, তার কন্যা জান্নাত স্ট্রোক করে মারা গেছে। সেখানকার চরআবাবিল ইউপি মেম্বার আবুল বাসার পলাশ জানান, “বিকালে রায়পুর থেকে এসে এখানে একটি এ্যাম্বুলেন্স দেখেছি। চলার পথে একজনকে জিজ্ঞেস করে শুনেছি নজির মোল্লার নাতনি মারা গেছে। আর কিছু জানি না”।
এদিকে, রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে উপস্থিত হয়ে যোগাযোগ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, ১৭ই অক্টোবর বেলা ১টা ১০ মিনিটে জান্নাত (১৫), পিতা: ইসমাইল, গ্রাম: চরদুঃখিয়া, উপজেলা : ফরিদগঞ্জ, জেলা : চাঁদপুরকে এখানে আনা হয়। তখন তার সাথে দুজন নারী ও একজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। সে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। অবস্থার অবনতি দেখে তাকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে জানতে চাইলে চরদুঃখিয়া গ্রামের কয়েকজন বলেছেন, শুনেছি জান্নাত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। এ খবর মানতে পারেননি তার বাবা। তিনি বিদেশ থেকে জান্নাতকে ফোনে শাসিয়েছেন। এরপর ১৪/১৫ দিন যাবত জান্নাত খাবার বন্ধ করে দিয়েছিল।
প্রতিবেশি স আদ্যাক্ষরের ব্যক্তি জানিয়েছেন, পোস্ট মর্টেম ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতির জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাই চেয়ারম্যান ওইদিন সন্ধ্যায় থানায় গিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে ফরিদগঞ্জের চরদুঃখিয়া (পঃ) ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান হাছান আবদুল হাই বলেন, জান্নাত আমার প্রতিবেশি। শুনেছি সে স্ট্রোক করে মারা গেছে। লাশ দাফনের জন্য আমি থানা থেকে অনুমতি এনে দেইনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি ওইদিন সন্ধ্যায় ফরিদগঞ্জ থানায় অন্য কাজে গেছি। কি কাজ- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, অন্য কাজ।
এদিকে, ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন বলেন, ১৭ তারিখে বিষ পানে বা স্ট্রোক করে কেউ মারা যাওয়ার খবর আমি জানি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেদিন সন্ধ্যায় আবদুল হাই চেয়ারম্যান থানায় এসেছিল। আমি দেখেছি। তবে আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।