Breaking News
Home / Breaking News / মতলবে ভাইফোঁটা উৎসব

মতলবে ভাইফোঁটা উৎসব

শ্যামল চন্দ্র দাস : বাঙালি সনাতন ধর্মালম্বীদের আরেকটি জনপ্রিয় উৎসব হচ্ছে ভাইফোঁটা। ভাই-বোনের মধ্যেকার অনিন্দ্য সুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। প্রথা অনুযায়ী শুক্লা তিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। পঞ্জিকার হিসেব মতে, কালীপূজার দুইদিন পরে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ‘ভাইফোঁটা’ উৎসব কেন করা হয় তার পেছনে অনেক পৌরাণিক ব্যাখ্যা বা কাহিনি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনা দেবী তার ভাই যমরাজের মঙ্গলকামনায় আরাধনা করেন; যার পূণ্যপ্রভাবে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। বোন যমুনাদেবীর পূজার ফলে ভাই যমের এই অমরত্ব লাভের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বর্তমান কালের বোনেরাও এই সংস্কার বা ধর্মাচার পালন করে আসছে। ভাইফোঁটা উৎসবে আজ ৯ নভেম্বর শুক্রবার এমনই একটি চমৎকার ভ্রাতৃত্ব পূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন, মতলব উত্তরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার। সহকারী কমিশনার (ভূমি) শুভাশীষ ঘোষকে ভাইফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, মতলব উত্তরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার। আমাদের সমাজে এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল। ভিন্ন এক কাহিনি মতে, একদা প্রবল পরাক্রমশালী বলির হাতে বিষ্ণু পাতালে বন্দি হন। দেবতারা পড়েছেন মহাবিপদে, কারণ কোন মতেই তারা নারায়ণকে বলির কবল থেকে বের করে আনতে পারছেন না। শেষপর্যন্ত এগিয়ে এলেন স্বয়ং লক্ষ্মী। তিনি বলিকে ভাই হিসেবে স্বীকার করেন। সেই উপলক্ষে তাঁর কপালে তিলক এঁকে দেন। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্বীকার করে বলি লক্ষ্মীকে উপহার দিতে চাইলে লক্ষ্মী চেয়ে নেন ভগবান বিষ্ণুকে। সেই থেকেই ভাইফোঁটা উৎসবের সূচনা। আরেক সূত্র মতে, এই দিনে নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। এই সকল পৌরাণিক ব্যাখ্যা বা কাহিনি যাই থাকুক না কেন, বর্তমানে ভাইফোঁটা একটি সামাজিক উৎসব। এই উৎসবে পারিবারিক সম্পর্কগুলো আরও পোক্ত হয়। তাই, ভাইফোঁটার ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্ব অনেক বেশি, যেখানে ভাই-বোনের মধ্যে কার প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্কটিই মুখ্য। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থনাই ‘ভাইফোঁটা’কে মহিমান্বিত করেছে। ভাইফোঁটা এমনই এক উৎসব যা ভাই-বোনের মধ্যেকার ভালোবাসা এবং স্নেহের সম্পর্ক খুব দৃঢ় করে। ভাই-বোনে সারা বছর ঝগড়া-ঝাঁটি থাকলেও, দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে। বোনের কাছ থেকে ভাইফোঁটার নেমন্তন্ন পেলে, দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে, যে কোনো প্রয়োজনীয় কাজ ঠেলে সরিয়ে রেখে ভাই আসবেই বোনের কাছ থেকে ফোঁটা নিতে। ভাইকে আদর করে সুতির আসনে বসতে দেওয়া হয়। বোনের হাতে থাকে ঝকঝকে পেতলের রেকাবি। রেকাবি সাজানো হয়, ঘরে তৈরি কাজল, চন্দনবাটা, ধান-দুর্বা, শুকনো পাটপাতা এবং মিষ্টি দিয়ে। পাশেই রাখা হয় ঘিয়ের প্রদীপ। বোন তার মধ্য আঙুলে কাজল ছুঁইয়ে ভাইয়ের দুই ভুরুতে এঁকে দেয়। এরপর চন্দনের ফোঁটায় কপাল অংকিত করে, কপালের ঠিক মাঝখানে মধ্য আঙুলকে স্পর্শ করে প্রচলিত ছড়া কাটে, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যমের দুয়ারে পড়লো কাটা/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই ভাইকে ফোঁটা।’ ছড়া শেষে বোন ভাইয়ের মাথায় ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে, পাশ থেকে বেজে উঠে উলুধ্বনি আর শংখধ্বনি। ভাইয়ের মুখে একটু তেতো নিমপাতা বা পাটপাতা তুলে দিতে হয়। ভাই কেতে তো মুখে বেশিক্ষণ থাকতে হয় না, সঙ্গে সঙ্গে থালা ভর্তি মিষ্টি খেতে দেওয়া হয়। শুধু কী মিষ্টি? মিষ্টির সঙ্গে ভাইকে বোনের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হয়। অবশ্য কোন কিছুই একতরফা হয়না। বোন যেমন ভাইকে দেয়, ভাইও বোনকে প্রণাম শেষে দিদির হাতে উপহার তুলে দেয়। আর বোন যদি বয়সে ছোট হয়, তাহলে বড় ভাইকে প্রণাম করে, ছোটবোনের হাতে উপহার তুলে দিতে ভাইয়ের আনন্দের সীমা থাকে না। এভাবেই ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। আমরা সামাজিক জীব। আমাদের সমাজ তৈরি হয় প্রথমে ঘর থেকে। মা-বাবা, ভাই-বোন দিয়ে যে পরিবার শুরু হয়, সেই পরিবারটিই সমযয়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন বিস্তৃত করে, ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশী, প্রতিবেশী পেরিয়ে পাড়া, গ্রাম ছাড়িয়ে একদিন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। ভাইফোঁটা উৎসব যেন সেই মানবিক বন্ধনকেই দৃঢ় করার তাগিদ দিয়ে যায়।

Powered by themekiller.com