Breaking News
Home / Breaking News / শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের দাবি প্রসঙ্গে

শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের দাবি প্রসঙ্গে

মোঃ রুহুল আমিনঃ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেন তাঁরা । এ যুদ্ধে দেশের সকল অঞ্চলের মানুষ স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেন। জাতির এই সূর্য সন্তানদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার দুইজন কীর্তিমান মানুষ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এমপি এবং অপর জন শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ অনোয়ার হোসেন বীর উত্তম। এ যুদ্ধে মোঃ আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। আমরা শাহরাস্তিবাসী অনেক ভাগ্যবান, কারণ আমাদের শাহরাস্তিতে ২ জন বীর উত্তম পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা।

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানে অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন, আরও অনেক কিছু করার কথা শোনা যায়। সরকারের এই উদ্যোগের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা জাতির সূর্য সন্তানদের সম্মানে আরও কী কী করা যায় তার জন্যে সংশ্লিষ্টদের মতামত আশা করি।

২০০১ সালে সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগে শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তমের নামে তাঁর নিজ গ্রাম শাহরাস্তির সোনাপুরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। সরকারের সহযোগিতা পেলে বিদ্যালয়টি ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা যায়। এই গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৫৮ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ও ৩ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। ভাঙ্গাচুরা ২টি দোচালা টিনের ঘরে কোনো রকমে বিদ্যালয়টিতে পাঠদানের কাজ চলছে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠের অবস্থাও বড় নাজুক।

আমরা দুঃখের সাথে বলছি, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মহান এই বীর শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তমের গ্রামে তাঁর পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অনেক অবহেলায় অনাদরে চলছে। এই বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করে আমাদের জাতীয় এই বীরকে যথাযথ সম্মানদানের জন্য এলাকার মানুষ প্রত্যাশা করছেন। এলাকাবাসী আশা করেন, বতর্মান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করে আমাদের মহান এই বীরকে সম্মানিত করবেন।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মার্চে মোঃ আনোয়ার হোসেন প্রশিক্ষণে ছিলেন। প্রশিক্ষণে থাকার কারণে দেশের পরিস্থিতির খবর সময়?মতো পেতেন না। ১৪ মার্চ তাঁর এক আত্মীয় ওয়াকার হাসান (বীর প্রতীক) গিয়েছিলেন যশোরে। তখন তিনি প্রশিক্ষণ থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকুরি করার। পাকিস্তান শাসনামলে সেনাবাহিনীতে অফিসার্স কোর্সে বাঙালি কেউ যোগ দিলেই তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দেয়া হবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। কোর্সে যাঁরা সবচেয়ে ভালো করতেন, তাঁরাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ পেতেন। আনোয়ার হোসেন এইচএসসি পাস করে ১৯৬৯ সালে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ অফিসার্স শর্ট কোর্সে। এতে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান তিনি। ১৯৭০ সালে তাঁকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে।

১৯৭১ সালে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। এ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি রেজাউল জলিল। অফিসারদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ও মোঃ আনোয়ার হোসেন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পাকিস্তানি। ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকলে তাঁদের রেডিও শোনা নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় আবার এই ব্যাটালিয়নের অর্ধেক যশোরের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রশিক্ষণে, অর্ধেক ছুটিতে ছিলেন। ২৫ মার্চ মোঃ আনোয়ার হোসেনও ছিলেন প্রশিক্ষণস্থলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর তাঁরা সময়মতো পাননি। ২৮ বা ২৯ মার্চ অধিনায?ক রেজাউল জলিল নির্দেশ দেন তাঁদের অবিলম্বে সেনানিবাসে ফেরার। সেদিনই তাঁরা সেনানিবাসে আসেন। সেনানিবাসে আসার পর রেজাউল জলিল সবাইকে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। তাঁর নির্দেশে তাঁরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও অস্ত্র জমা দেন। সেদিন তাঁরা বেশির ভাগ ছিলেন ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। এ জন্য তাঁরা রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। গভীর রাতে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট তাঁদের আক্রমণ করে। নিরস্ত্র সৈনিকদের কয়ে?কজন ঘুমন্ত অবস্থাতেই শহীদ হন। বেঁচে যাওয়া সৈনিকেরা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। সৈনিকেরা অধিনায়ক রেজাউল জলিলকে অনুরোধ জানান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও আনোয়?ার হোসেন সৈনিকদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় একাত্মতা প্রকাশ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে সৈনিকেরা বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। হাফিজ উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন এই অসম যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শন করেন। তাঁদের সাহস ও বীরত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও মনোবল বেড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এর মধ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনেকে শহীদ ও অনেকে আহত হন। এক পর্যায়ে তাঁদের গোলাগুলিও কমে আসতে থাকে। এ অবস্থায় হাফিজ ও আনোয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সেনানিবাস এলাকা ছেড়ে চৌগাছায় একত্র হবেন। এরপর তাঁরা ফায়ার অ্যান্ড মুভ পদ্ধতিতে খোলা মাঠ দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকেন। আনোয়ারও সেভাবে পশ্চিম দিকের খোলা মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময়? হঠাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেশিনগানে ছোড়া গুলি এসে লাগে আনোয়ার হোসেনের কোমর ও পিঠে। গুলির আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে তিনি শহীদ হন। প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে নেন। সেখানে স্থানীয় জনগণ তাঁকে নজরুল ইসলাম কলেজের সামনে সমাহিত করেন।

আমরা কালে-ভদ্রে জাতির এই বীরদের স্মরণ করি কোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আমাদের উচিত তাঁদের মহান আত্মত্যাগকে স্মরণ করা আমাদের প্রতিটি কাজে। আর তা হলেই আমরা আমাদের সূর্য সন্তানদের প্রতি কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করেছি বলে মনে হবে। আমরা মনে করি, শহীদ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট মোঃ আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তমের নামে পারিবারিক উদ্যোগে স্থাপিত তাঁর নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হলে কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি বলে মনে হবে। আমরা আশা করবো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

Powered by themekiller.com