Breaking News
Home / Breaking News / দুই বাংলার বৃহত্তম নেটওয়ার্ক দৈনিক শব্দনগরের সেরা চার সাহিত্য

দুই বাংলার বৃহত্তম নেটওয়ার্ক দৈনিক শব্দনগরের সেরা চার সাহিত্য

// তুমি আছো বলেই //
>=<>=<>=<>=<>=<>=< জানো নীলাঞ্জনা ; তুমি আছো বলেই পৃথিবীকে এতো সুন্দর মনে হয়, শুধু তুমি আছো বলেই আরও কিছু দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। তুমি আছো বলেই দুঃখ ভুলে এখনো হাসতে পারি, তুমি আছো বলেই গভীর নিশিতে ডায়েরির পাতায় ছন্দ খুঁজি । শুধু তুমি আছো বলেই গোধূলি লগ্নে পাখিদের গল্প শুনি, তুমি আছো বলেই শরৎ হেমন্ত শীত ও বসন্তে ফুল ফুটে। তুমি আছো বলেই কারণে অকারণে অভিমান পুষে রাখি, তুমি আছো বলেই অপেক্ষার প্রহর গুলো উপভোগ করি। তুমি আছো বলেই ভালোবাসাটা অনুভব করি, তুমি আছো বলেই আকাশের নীলে এখনো প্রেম খুঁজি। তুমি আছো বলেই ইট-শুরকি আর বিষাক্ত সীসার অথৈ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে - চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি তোমায়, শুধু তোমার জন্যই মনে হয় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি এই বাংলায় । ____🖊️চিছাম মনির। রচনাকালঃ ০৭/০৩/২২ইং, ঢাকা, বাংলাদেশ ।

——————————————–
#মার্বেলের বাথটাব এবং বাসন্তী, চামেলি, ননীবালাদের নারী দিবস

#সুস্মিতা

(হাটে বাজারে জন্ম, সেখান থেকেই চির বিদায়। হাটের মাঝেই শোওয়া, বসা, খাওয়া, থাকা। এইরকম জীবন যে নারীদের, তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের গল্প)

সূর্য ওঠারও ঢের আগে আজ পটলা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেই ও মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। তাছাড়াও ঘুমানোর আগে উপুড় হয়ে বালিশে মানে ছয় সাতটা পুরোনো খবরের কাগজকে একটা চটের ব্যাগে ভরে যেটা ওর বালিশ, সেটায় মুখ ডুবিয়ে পটলা বলেছিল- “হে ভগবান, কাল যেন সূর্য ওঠার অনেক আগে রাত থাকতে থাকতেই ঘুমটা ভেঙে যায়।” ছেলেবেলায় পটলা মায়ের কাছে শুনেছিল, এটা হল একটা তুক। বালিশকে বলে রাখলে সে ঠিক সময়মতো জাগিয়ে দেয়। সকলের কাছে কি আর অ্যালার্ম ঘড়ি থাকে? যাক গে সেসব কথা।

আজ পটলার হেব্বি দায়িত্ব। রাত থাকতে থাকতেই পাড়ার বড় মার্কেটে পৌঁছে যেতে হবে।

চামেলি, রেখা, পদ্মা, ননীবালা, মালতী এবং ওদের মতো আরও অনেকে ওই বাজারেই থাকে, রাতে ওখানেই ঘুমায়। ওদের ঘরবাড়ি নেই। ওদের কারুকে পটলা মাসী, কারুকে পিসী ডাকে। কেউ বা আবার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাদের জন্মও হয়ত হয়েছিল ওই বাজারের মধ্যেই। তারা পটলার দিদা ঠাকুমা।

ভোর হ’তে না হ’তেই ওই মাসী, পিসী দিদাদের কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। সে এক লড়াই বটে। পড়িমরি করে সকলের দৌড় শুরু।

কারুকে যেতে হবে স্টেশনের দিকে। ট্রেনে করে ফুল আসবে। পাইকারি দরে ফুল নিতে হবে। আবার এসে বসতে হবে বাজারে। পুজোর ফুলের বেশিরভাগ বিক্রিবাটাই একেবারে সকালের দিকে। অনেক খদ্দেরেরই আবার পুজোর জন্য ফুলের মালা চাই। এরই মধ্যে হাত চালিয়ে হাজারে হাজারে মালা গেঁথে ফেলতে হবে। ফুল, মালা, বেলপাতা নিয়ে কেউ কেউ চলে যাবে কালীঘাট কিম্বা দক্ষিণেশ্বর।

ননীদিদাদের মতো বুড়িরা আজকাল আর আগের মতো হুটপাটি করে কাজ করতে পারেনা। ভগবানের দয়ায় আজকালকার গেরস্থ ঘরের মেয়েবৌরাও মাছটাছ তেমন কায়দামতো কাটতে টাটতে পারে না। তো, তাদের কল্যাণেই দিদা এখন শংকরদার মাছের দোকানে অ্যাসিস্টেনটের অর্থাৎ খদ্দেরদের জন্য মাছ কেটে দেওয়ার কাজ করে। রহিমচাচার পেঁয়াজ রসুন আর হাঁস মুরগীর ডিম নিয়ে বাজারে বসে মালতী পিসী। কোনো কোনো রাতে রহিমচাচার কাছে শুতে যায়। বাকি দিন রাত এই বাজারেই। ওর সাত কূলে আর কেউ নেই। বেলা বারোটা পর্যন্ত বাজার সামলিয়ে পিসী চলে যায় এক বাড়িতে বাচ্চা সামলানোর কাজ করতে।

নানারকম শাক পাতা বেচে খায় পদ্মাদিদি। ওইটুকুই ওর সম্বল। সুবলকাকা শাকের যোগান দেয়। দুপুরে বিড়ি বাঁধার কাজ।

নারায়ণী ঠাকুমার সঙ্গে তার পাগল মেয়ে চম্পাও এই বাজারেই থাকত। এই বাজারেই কতবার যে সে পোয়াতি হয়েছিল। বাচ্চাদের বাপেদেরও কোনও ঠিকঠিকানা কোনোবারই পাওয়া যায়নি। সবগুলো বাচ্চা অবশ্য বাঁচেওনি। সে একদিকে ভালোই হয়েছে। ভোটের সময় গুনতি বৃদ্ধি ছাড়া ওদের আর কি প্রয়োজন এই দুনিয়ার।

তা সেই নারায়ণী ঠাকুমাও এখন মরে ভূত হয়ে গিয়েছে। চম্পা কোথায় চলে গিয়েছে কেউ খবর রাখে না। কিন্তু পাগলী চম্পার এক মেয়ে ওই চামেলি এখনও এই বাজারেই থাকে। আর যাবেই বা কোথায়?

চামেলির সঙ্গে এই বাজারের অন্য মাসী, পিসী, দিদারা তেমন কথাবার্তা বলেনা। ওকে কেমন যেন একটু একঘরে করে রাখে। পটলা সব বুঝতে পারে। আসলে এই বাজারে থাকা মাসীদেরও আছে নিজেদের সমাজ। তার নিজস্ব নিয়ম কানুন। সমাজ থাকলে তার নিজস্ব সামাজিক বৈষম্যের নীতিও থাকতেই হবে। পেটে ভাত থাকুক না থাকুক জাতপাত, উঁচু-নীচুর বিভেদ এখানেও আছে। বাপের পরিচয়বিহীন চামেলি তাই এখানে একঘরে। ও সকাল সকাল কোথায় কাজ করতে চলে যায়, কেউ জানে না। পটলা অবশ্য জানে, চামেলি একটা ভালো কাজ পেয়েছে। মাইল ছয়েক দূরে এক সুলভ শৌচাগারে ডিউটি করে চামেলি। শৌচাগার পরিষ্কারের কাজ।

বাজারের পদ্মাদির নয় বছরের বেশ ডবকা মেয়ে টিকলি। টিকলির জন্ম এই বাজারেই। ওর বাবা নবকাকা করিমচাচার দোকানে মুরগি কাটত। তখন ওরা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত। কিন্তু পদ্মাদিদির পোয়াতি অবস্থাতেই নবকাকা এক অজানা জ্বরে পট করে মরে গেল। তার কিছুদিন পরে থেকেই পদ্মাদিদি মেয়েকে নিয়ে এই বাজারে। শাক পাতা বেচে কোনও বস্তিতেও ওর ঘরভাড়া জোটে না।

টিকলিকে নিয়ে পটলার বন্ধু হাবুল আজকাল একটু ইন্টুমিন্টু খেলে। মেয়েটা তো প্রায় অবোধ শিশু, কিন্তু বাজারের কুড়িয়ে বাড়িয়ে খেয়েই সে বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমা রাতের রুপোলি জ্যোৎস্না যখন বাজারের পেছনের পুকুরপাড়ে পিছলে পড়ে, হাবুল তখন টিকলিকে পুকুরপাড়ের ঝোপের ধারে নিয়ে যায়।

পটলার এক একসময় বড্ড রাগ হয়ে যায়, বাচ্চা মেয়েটার জন্য বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে কিন্তু সুবিধাবাদীমানুষের মতো ও চুপ করেই থাকে। এই বাজারের কতজনের আব্রু রক্ষা করতে পারবে ও? ঠিক এইরকম মুহূর্তগুলোতেই পটলা ওর নিজের পাঁচ বছর বয়সে মরে যাওয়া বোনটার জন্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এই তো সেদিন মাঘী পূর্ণিমার সন্ধেতেও হাবুল টিকলিকে নিয়ে হাওয়া খাওয়াতে বেরিয়েছিল। কিন্তু ঘন্টাখানেক পরে ফিরেছিল ব্যাজার মুখে।

পটলা বারবার কারণ জানতে চাইলে হাবুল বলেছিল- “আর বলিস না, একটা এগরোল খাইয়ে টাইয়ে সবেমাত্র মেয়েটাকে দুহাতের মধ্যে একটু কব্জা করে ধরেছি, নিজের স্মার্টফোনটাও দিয়েছি ওর হাতে একটু ব্যস্ত রাখার জন্য, যাতে কিনা বিনা বাধায় টিকলির জামার ভেতরের পাতিলেবুদুটো ঠিকঠাক দলাইমলাই করা যায়…কিন্তু সেই মেয়ের মুখে শুধু একটাই কথা।”

“কিরকম? কিরকম?- পটলা একটু উৎসাহী হয়ে জানতে চায়। হাবুল আবার বিরক্ত কণ্ঠে বলে- “আরে কি যে মাথায় ঢুকেছে মেয়েটার, ওই রাস্তার হোর্ডিংয়ে সাবানের বিজ্ঞাপনে কারিনা কাপুরের ছবিটবি দেখেই বোধহয়…সারা সন্ধে শুধু একটাই কথা বলে গেল।” পটলা অবাক হয়ে জানতে চায়- “ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের মাথায় কি কথা রে হাবুল? তাও আবার কারিনা কাপুরকে দেখে?” জমে ওঠার আগেই খেলা ভেঙে যাওয়ায় মেজাজ খারাপ হাবুলের, নেশাটাও জমল না, একটা জব্বর গালি দিয়ে সে বলল- “আরে যতবারই মালটাকে চটকেফটকে পজিশনে সেট করতে যাচ্ছি, ততবারই তার এক প্রশ্ন- আচ্ছা হাবুলদা সত্যিই বড়লোকদের বাড়িতে

স্নান করার জন্য অত বড় আলাদা ঘর থাকে? সেখানে আবার ওইরকম বড় আলাদা স্নানের গামলা? সত্যি হাবুলদা?” কানের মাথা খেয়ে ফেলল মাইরি।”

হাবুলের কথা শুনে পটলা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে গিলে নিলো। অনেকদিন পরে মনে পড়ে গেল ওর সাত বাড়িতে খেটে খাওয়া মায়ের কথা।

সেসব বহু বছর আগের কথা। বাবা তখন বেশিরভাগ সময়ই খাটিয়ায় শুয়ে থাকে, ঘঙ ঘঙ কাশে আর গয়ের তোলে।

ঠিকে ঝিয়ের কাজে যাওয়ার জন্য মা’কে প্রায় কাকভোরে বস্তির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হত। তার আগে স্নান পায়খানা সেরে ফেলতে হবে। কিন্তু বস্তির বেশিরভাগ মানুষের জীবনই তো ওই একইরকম। অতএব রাত প্রায় চারটে থেকে পায়খানার সামনে লম্বা লাইন।

পূর্ববঙ্গ থেকে রেফিউজি হয়ে আসা পটলার মায়ের বোধহয় ওই পায়খানার লাইনে দাঁড়াতে বড্ড কষ্ট হত, বড্ড লজ্জা…নারীত্বের আব্রুর লজ্জা। কাজে বেরোনোর আগে এক একদিন মাকে কেঁদে ফেলতে দেখেছে পটলা। মনের দুঃখে নিজের মনে বকবক করতে করতে মা বলত- “যদি কোনোদিন ভগবান সুদিন ফিরিয়ে দেন, যদি কোনোদিন আবার নিজের ভিটে হয়, তবে সবার আগে সেখানে ভদ্রলোকের মতো একটা পায়খানা বাথরুম বানিয়ে নেবো।

নিজের অক্ষমতার লজ্জা ঢাকতে কখনোসখনো ঝাঁজিয়ে উঠত পটলার বাপ, বলত- “হ্যাঁ, নিজের বাড়ি…একেবারে জমিদারের মেয়ে ছিলেন কিনা উনি পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে।”

চোখের জল মুছতে মুছতে মা উত্তর দিত- “জমিদার ছিলাম না ঠিকই, তবুও তো নিজেদের একটা বাড়ি ছিল। এমন লাইনে দাঁড়িয়ে পায়খানা তো যেতে হত না। উঠোনের এক কোণে নিজেদের ব্যবস্থাটুকু তো ছিল।”

নাহ স্মৃতির তাড়নায় আড্ডার তাল কেটে গেল। আজ আর কিছু ভালো লাগছে না। উঠে পড়ল পটলা।

তা যে কথা হচ্ছিল একেবারে শুরুতে। আজ সেই ভোররাতে উঠে পড়তে হয়েছে পটলাকে। আজ পটলার অনেক দায়িত্ব অনেক কাজ।আজকের দিনটা একটা বিশেষ দিন, একটা গালভরা নামও আছে আজকের দিনটার- “আন্তর্জাতিক নারী দিবস।”

প্রত্যেক বছরই অবশ্য এই দিনটা আসে, অনেক ঘটা করে ফাংশনটাংশন হয়। এবারের বিশেষত্ব হল- এবার এই রাজ্যের বিধানসভার ভোট একেবারে দোরগোড়ায়। এই মাসের শেষেই।

অতএব এই বাজারে থাকা মাসি, পিসি, দিদাদের এবার হেব্বি ডিম্যান্ড। যাদের মাথার ওপরে ছাদ নেই, ঘর নেই, পেটভরা ভাত নেই, নেই কোনও আব্রু ভোটের বাজারে তাদের মাথার গুনতিটা বড্ড দামি। তাছাড়া ফ্রীতে একথালা ডিমেরঝোলভাত, দুটোরুটি, আলুভাজা, একটা লাড্ডুর বিনিময়ে নেতাদের সভা সমাবেশ ভরিয়ে তোলে যে এরাই।

সেইসঙ্গে পাড়ায় যে কোনও কাজে বেগার খাটার দরকার পড়লেই পার্টি পলিটিক্স, দল নির্বিশেষে ডাক পড়ে পটলার। এবার তো সব পার্টি থেকে ঘনঘন ডাক আসছে।

তো, আজ এই বাজারের মাসীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করা হবে। সারাদিন ধরেই উৎসব করবে সব পার্টিই। তা কোন পার্টির অনুষ্ঠান কখন হবে, সে নিয়েও প্রচুর ক্যাচাল হয়েছে।

যাইহোক যেহেতু এই মাসীদের ঘরদোর কিছু নেই, সারাদিনের কাজকর্মের শেষে বাজার কোনরকমে ধোয়ামোছা করে এই চাতালেই মাসীরা শুয়ে থাকে, তাই তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নেতারা এবার দারুণ চিন্তিত। হাজার হোক অনেক ফিল্মি লোকজন আসছেন আজকের আসর জমাতে। জনদরদী নেতারা, নায়ক নায়িকারা এইসব বাজারী মাসীদের জড়িয়ে ধরে ছবি তুলবেন। ওরা যদি চান টান করে গায়ে একটু পারফিউমটিউম না মেখে রাখে…। গন্ডাখানেক টেলিভিশন চ্যানেল, খবরের কাগজের ফটোবাবুরাও থাকবে। ছবিটবি উঠবে…। ভিডিও হবে।

পটলার দায়িত্ব পড়েছে, একেবারে সকাল থেকে এই বাজার যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার চকচকে করে রাখা হয় সেটা দেখার। মাছমাংস, পচে যাওয়া সবজির গন্ধটন্ধ যেন না থাকে। ফুল ধূপধুনো জ্বালিয়ে সেসব চাপা দিয়ে রাখতে হবে। সব পার্টি থেকেই মাসীদের কিছু টাকা, নতুন কাপড় দেওয়া হয়েছে। মাসীরা যেন সেজেগুজে পরিষ্কার হয়ে থাকে। আজ তাদের রোজগারে যেতে হবেনা। তাদের আজকের খাওয়া ফ্রী।

এইসব ব্যবস্থাপনা করতেই পটলা আজ ভোর থেকে বাজারে উপস্থিত। আজ প্রথমবার ওর মনে হচ্ছে নিজের বস্তিতে তবুও একটা নির্দিষ্ট স্নান পায়খানার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই বাজারে থাকা মাসীপিসীদের? যারা এখানেই জন্মায়, এখানেই থাকে? এখান থেকেই চিরবিদায় নেয়…তাদের প্রতিদিনের আব্রু কিভাবে রক্ষিত হয়? কোথায় যায় তারা?

নাহ পটলা আর অতশত ভাবতে পারে না। তার চেয়ে আজকের দিনটা ওদের ভালো কাটলেই হল। নামী লোকজনরা এসে অনেক দামি সব কথা বলবে। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বিক্রি করবে। আর কি চাই।বেশিরভাগ সমস্যা থেকেই চোখ বন্ধ করে, পিঠ ফিরিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ…।

পেছন ফিরে দাঁড়ায় পটলা। বাজারের ঠিক ঢোকার মুখেই বিরাট বড় করে সাবানের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। বিশাল বড় মার্বেলের বাথটাবে সুন্দরী অর্ধনগ্ন নায়িকা সারা গায়ে সুগন্ধি সাবান মেখে স্নান করছেন।

তার দিকে চেয়ে পটলা বিড়বিড় করে বলে- “হ্যাপি উইমেন্স ডে।”…

——————————————–

শিরোনাম – তুমি কি চাও
কলমে- অসীমা দেবী
০৭.০৩.২২

তুমি আর কবে বুঝবে!
শুধু বোঝার ভান কর,
তোমার সাথে লড়াইয়ে
আর পেরে উঠতে পারছি না,
নিস্তব্ধ পরিবেশে তোমার আত্মপ্রকাশ,
নীরে নীরে বেড়ে উঠেছিলে সেদিন,
কত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর
তুমি এইতো এলে;
ডাইনোসরদের আশেপাশে,
তোমার অশরীরী চোখ খুঁজছিল অস্তিত্ব।
তুমি কোথায় ছিলে তখন?
তোমার এই হোমো স্যাপিয়েন্স হয়ে ওঠার
ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প,
আজ তুমি ভুলে যেতেই পার,
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে
কত ধাপ পেরিয়ে এসেছ,
তুমি নাকি আজ একমাত্র স‍ভ‍্য জীব!
তাই বুঝি এত আত্মশ্লাঘা!
তোমার জন‍্য তুমি সৃষ্টি করলে কৃত্রিম অমরাবতী,
আবার সৃষ্টি করেছ নরকও,
আজ তোমার আতিশয্য দেখছে সকলে।
দেখছে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের ফলে
লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া অন্তরীক্ষ,
দেখছে নির্বাক প্রকৃতি,
দেখছে ভয়ে শিউরে ওঠা শৈশব।
আজ বুভুক্ষুর প্রতিটি গ্রাসে গ্রাসে
তোমার প্রতি অভিসম্পাত,
যে গ্রাস তুমি ছিনিয়ে নিচ্ছ প্রতিনিয়ত।
তোমার সুন্দর মুখাবয়বের অন্তরালে,
তুমি যেন এক ভয়াবহ ড্রাগন।
মুখ নিঃসৃত আগুনে সবকিছু করছ ছারখার।
ধর্মের নামেও আজ অবনীতে ছড়িয়ে দিচ্ছ হিংসা,
আজ হিংসাও যেন লজ্জা পাচ্ছে তোমার হিংস্রতার কাছে।
নবজাতকদের লোচনে আজ বিভীষিকার চিহ্ন,
চিহ্নিত তুমিই তো করলে।
রেখে যেতে পারবে তো তাদের জন‍্য
বিশুদ্ধ বায়ু, উর্বর জমি, আর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ!
যেখানে প্রথম হয়েছিল তোমার চেতনার আত্মপ্রকাশ,
সেখানেই হতে পারে তোমার চির সমাধি।

——————————————-

মিথ্যে গল্প নয়, একদম সত্যি
দোলা ভট্টাচার্য
7.3.2022

সুকুমার ও মায়াদেবী র প্রথম সন্তান লীলাময়ী যখন বাবা মায়ের আদরে সোহাগে বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে, তখনই পাওয়া গেল দ্বিতীয় কারও আগমন বার্তা। মায়া আবার অন্তঃসত্ত্বা। সুকুমার, মায়া দুজনেরই ইচ্ছা, এবার একটা ছেলে আসুক। ঈশ্বর পূরণ করলেন ওদের সেই ইচ্ছা। ছেলে হওয়ায় সুকুমার ও মায়ার সাথে বাড়িশুদ্ধ সকলেই খুব খুশি। লীলাও একদিন বাবার কোলে চেপে হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে দেখে এল। “কি সুন্দর পুতুলের মতো ছোট্ট একটা ভাই! জানো বম্মা, এইটুকু টুকু কি সুন্দর হাত ওর, আর এইটুকু টুকু পা। আবার ওঁয়াও ওঁয়াও করে কাঁদে।” বাড়ি ফিরে বড়মার সাথে বসে গল্প করছিল লীলা। বড়মা তো হেসেই অস্থির, “ওরে, তুইও তো ওরকমই ছিলি। তা হ্যাঁ রে,ভাই বাড়ি এলে, সবাই তো ওকে খুব আদর করবে। তোর আদর কমে যাবে কিন্তু। ভাইটাকে আবার হিংসে করবি না তো।” হিংসে শব্দ টা মাথায় ঠিক প্রবেশ করল না ছোট্ট লীলার। আধো আধো উচ্চারণে বড় মাকে বলে লীলা, “ভাই এলে ওকে আমি অনেক আদর করব দেখো।”
দুদিন পরে, সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন মায়া।”আমার নতুন ভাই এসেছে! কি মজা!”আনন্দের চোটে কি করবে ভেবে পায় না লীলা। খুব সুন্দর একটা পুতুল ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মায়া বললেন, “এই দেখো, ভাই এটা এনেছে তোমার জন্য। তুমি যেন ওকে হিংসে কোরো না “। “আশ্চর্য! সকলে মিলে ধরেই নিয়েছে, বাচ্চা মেয়েটা ওর সদ্যোজাত ভাইকে হিংসা করবে! কেন! ”
পড়শি গিন্নীর মুখে প্রতিবাদ শুনে মায়ার বড় জা প্রভা বললেন, “এটাই তো স্বাভাবিক। এতদিন ও ই তো একেশ্বরী হয়ে ছিল। এখন তো ওর থেকে ওর ভাই বেশি আদর পাবে। ও কি সেটা সহ্য করতে পারবে !”
পড়শি গিন্নী বললেন,” এ আবার কি কথা! হিংসা শব্দটার মানে ও জানে? আরে, তোমরাই তো বলে বলে ওইটুকু শিশুর মধ্যে হিংসার বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছো।”
পাঁচ বছর বয়স হল লীলার। এবার ইস্কুলে ভর্তি হতে হবে ওকে। বাড়িতে জোর প্রস্তুতি চলেছে। এখন হাতের আঙুল গুনে গুনে যোগ, বিয়োগ করতে পারে লীলা। অ আ ক খ A B C D এসবের সঙ্গেও পরিচয় হচ্ছে ধীরে ধীরে। একদিন বাবার হাত ধরে বাড়ির কাছে এক স্কুলে ভর্তি হয়ে এল। সামনের সপ্তা থেকে রোজ স্কুলে যেতে হবে। খুব আনন্দ হচ্ছে লীলার। কত বন্ধু ওখানে। সবার সাথে কত খেলা হবে। ছোট্ট ভাইটার সাথে গল্প করে লীলা। ভাই তো শুধু হাত পা ছুঁড়ে খেলা করে এখন। মুখে বোল ফোটেনি। তবে দিদির কথা কান খাড়া করে শোনে। সেদিন সকালে,সুকুমার অফিসে বেরিয়ে যাবার পর লীলাকে নিয়ে পড়লেন মায়া, “দুদিন পর থেকে তোমায় ইস্কুলে যেতে হবে তো। পড়াশোনা করতে হবে মন দিয়ে। নাও, এই অঙ্ক গুলো এখনই কষে ফেলো তো। আমি স্নান করতে যাচ্ছি। এসে যদি দেখি অঙ্ক হয়নি, তাহলে কিন্তু খুব বকবো। আর হ্যাঁ, ভাই এর দিকে একটু খেয়াল রেখো।” মেয়েকে অঙ্ক কষতে দিয়ে চলে গেলেন মায়া। অঙ্ক কষতে কষতে লীলা লক্ষ্য করল, ভাইটা আপন মনে হাত পা ছুঁড়ে খেলে যাচ্ছে। ওকে একটু আদর করে দিয়ে আবার অঙ্কে মন দিল।
অঙ্ক শেষ হয়ে গেছে। মা স্নান সেরে ঘরে আসেনি এখনও। ভাই খুঁতখুঁত করে কাঁদতে শুরু করেছে। তার মানে হিশি করেছে ভাই। ওর কাঁথা পাল্টাতে হবে। এগুলো মাকে দেখে দেখে শিখে ফেলেছে লীলা। ভাইয়ের কান্নার ধরণ গুলোও চিনে ফেলেছে। কিভাবে কাঁদলে খিদে পেয়েছে, বা কোনো অসুবিধা হচ্ছে, আবার কোন কান্নাটা নিছকই দুষ্টুমির, কোলে ওঠার বায়না, সবই মোটামুটি বুঝতে পারে লীলা। এসব দেখে পড়শি গিন্নী বলেন, “মেয়েরা মায়ের জাত। এসব ওদের সহজাত, শেখাতে হয় না”। ভাইয়ের ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো তুলে ভিজে কাঁথাটা টেনে বার করে নিল লীলা। শুকনো কাঁথায় ভাইকে শোয়ানোর সময়ে হঠাৎই একটা বদবুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বড়সড় একটা পাশবালিশের ওয়ার খুলে নিয়ে ভাইকে চটপট তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।মতলব, ভাইয়ের জায়গায় শুধু ওকে দেখে অবাক হয়ে যাবে মা। ভাইকে খুঁজবে। কিন্তু পাবে না। তারপর ম্যাজিক করে ও বার করে দেবে ভাইকে। দিদির আদর ভাই চেনে। তাই চুপচাপই ছিল এতক্ষণ । এইবার জুড়ল চেঁচামেচি।তীব্র চিৎকারে ভয় পেয়ে গিয়ে ওয়ারের মধ্যে থেকে ভাই কে বার করে দিতে গেল লীলা । কিন্তু পারল না। হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভাই গেল গড়িয়ে। খাট থেকে নিচে পড়ে গেল ভাই। ছুটে গিয়ে মাকে খবর দিল লীলা, “মা। শিগ্গির এসো। ভাই পড়ে গিয়েছে খাট থেকে।”
ছমাসের বাচ্চা, বেঁচে গেল অদ্ভুত ভাবে, কোনো কাটা ছড়া ছাড়াই। কিন্তু লীলা! সকলে ওকে যখন বলছিল, “কিরে! এত হিংসে তোর! ভাইটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি!” পাঁচবছর বয়সী বাচ্চা মেয়েটা সেদিন হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়েছিল ওর অভিভাবকদের দিকে,” ভাইকে আমি মেরে ফেলতে চাইব কেন! ওকে তো আমি খুব ভালোবাসি” ।ওর অনুচ্চারিত কথাগুলো কেউ শুনতে পায়নি সেদিন। চিরদিনের জন্য কলঙ্ক লেপে গিয়েছিল ওর কপালে। লীলার বিয়ের পর ওর স্বামীকেও হাসতে হাসতে বলেছিলেন ওর বাবা, “লীলার খুব হিংসা জানো তো । ওর ভাইকে তো একবার মেরেই ফেলতে যাচ্ছিল ও। অথচ আমার ছেলে সুপ্রিয় কিন্তু খুব ভালোবাসে ওকে। ছোটবেলায় সুপ্রিয় কে কেউ লজেন্স বা অন্য কোনো জিনিস দিলেই, ও দিদির জন্যেও একটা চেয়ে নিত। কিন্তু লীলাকে কেউ কিছু দিলে, ও কিন্তু ভাইয়ের কথা বলত না।” কথাটা খুব সত্যি। কারণ লীলাকে কেউ কিছু দিলে, লীলা কিছুতেই নিত না। এরকমই শেখানো হয়েছিল ওকে। বাবা মা না বললে, ও হাতই বাড়াতো না। আর সুপ্রিয় ছিল দস্যি। ওকে এসব শেখানো যায়নি। আর সুপ্রিয় অবলীলায় যেটা করতে পারে, ওর থেকে পাঁচবছরের বড় দিদি হয়ে লীলা সেটা কি করে করে! আর বড়রাই বা কতরকম কথা বলে! একবার বলছে, “কেউ কিছু দিলে নেবে না, কারও কাছে কিছু চাইবে না।” আবার আর এক সময়ে আর এক রকম বলছে! কোনটাই বা শুনবে ও!
লীলা আর সুপ্রিয় বড় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সুপ্রিয় এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। আর লীলা নাইনে। মায়ার ইচ্ছায় একটা আঁকার স্কুলে সুপ্রিয় কে ভর্তি করে দিয়েছেন সুকুমার। পড়াশোনার সাথে এটাও শিখুক। লীলার ও খুব গান শেখার ইচ্ছে। যদিও মায়া চান না মেয়ে গান শিখুক। লীলার বায়না ফেলতে পারেন না সুকুমার। ভর্তি করে দিলেন গানের স্কুলে।
গান খুব ভালোবাসে লীলা। রোজ সন্ধ্যায় রেওয়াজ করতে বসে। মায়া বলেন, “সন্ধ্যায় নয়। এই সময়ে বাড়িতে লোকজন চলে আসে। তোর গলা একদম বাজে।আমার লজ্জা করে খুব। ভোর চারটেয় রেওয়াজে বসবি”। লীলা অবাক। গানের দিদি ওর কত প্রশংসা করে। আর মা বলছে ওর গান শুনলে লজ্জা করে! তাই একটু রাগ দেখিয়েই বলল, “অত সকালে আমার গলা বেরোয় না মা। আর ওই সময়ে উঠে পড়তে বসতে হয় আমাকে।তারপর ছটায় পড়তে যাওয়া, ফিরে এসে আবার স্কুল। ওই সময়ে রেওয়াজে বসা অসম্ভব আমার পক্ষে।” সুকুমার বললেন, “ওর যে সময়ে সুবিধা, তখনই রেওয়াজ করুক। অতো জোর কোরো না মায়া।
সুপ্রিয়র আঁকার স্কুলের টিচার একদিন বাড়ি এসে অভিযোগ করে গেল, “আপনাদের ছেলে তো কিছুই পারে না। শেখার চেষ্টাই নেই।” মায়া বললেন, “কি বলছেন! ওর খাতায় কত সুন্দর সব আঁকা রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই তো একটা করে নতুন আঁকা দেখি”।
“ওগুলো তো আমার আঁকা। আমি সবার খাতাতেই একটা কিছু এঁকে দিই। ওরা সেইটা দেখে প্র্যাক্টিস করে। আর আপনার ছেলে চুপ করে বসে থাকে। আমি সেদিন ওকে চেপে ধরলাম। বলল, ও আঁকতে ভালোবাসে না। কেন শুধু শুধু পাঠাচ্ছেন ওকে আমার কাছে “! এ কথা টা লীলাও জানত। ভাই আঁকতে ভালোবাসে না। মাকে বলেও ছিল ও। বকুনি দিয়ে মা থামিয়ে দিয়েছিল ওকে।
আঁকার জন্যে সুপ্রিয় কে আবার অন্য জায়গায় ভর্তি করা হল। এখানে মাইনেটা আরও বেশি।
সন্ধ্যায় লীলা গানের রেওয়াজে বসেছে ।নতুন একটা গান তোলাচ্ছে দিদি। কলিং বেল বাজল। কেউ এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা এসে বলল, “গান বন্ধ কর। বাবার কাছে লোক এসেছে।”
“তাতে কি হয়েছে মা! আমি তো এখানে। লোক এসেছে বাবার ঘরে। অসুবিধা কোথায়!”
“তোর গলা ভীষণ বাজে সোনা ।লোকে শুনলে কি বলবে! উঠে পড় শিগ্গির।”
এরকম প্রায়ই হতে লাগল। অবশেষে লীলার গানের স্কুল যাওয়া বন্ধ করলেন মায়া। সুকুমার কে বোঝালেন, আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে এতগুলো টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। ছেলেকে আঁকাটা শিখতেই হবে। কিন্তু মেয়ের গান শেখার কোনো প্রয়োজন নেই। ও তো কোথাও শো করতে যাবে না। পড়াশোনা টা করুক। ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য ওটা খুব প্রয়োজন।”
গানের দিদি বাড়িতে চলে এলেন একদিন। “লীলা এত সুন্দর গান গায়। ওকে গান টা কন্টিনিউ করতে দিন”। মায়া কিছুতেই রাজি হলেন না। বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে রইলো লীলার সাধের হারমোনিয়াম। মায়া পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। মেয়ের থেকে ছেলেকে টানতেন বেশি। বাড়িতে ভালো কোনো খাবার এলে চারটে ভাগ হতো, দুটো ভাগ বেশি, দুটো ভাগ কম। বেশি ভাগ দুটো সুপ্রিয় আর সুকুমারের। কম দুটো ভাগ লীলা আর মায়ার। এরপরেও নিজের ভাগ থেকে অর্ধেক ছেলেকে দিতেন মায়া। প্রতিবাদ করলেই শুনতে হতো, “এতো হিংসে ভালো নয় লীলা”।
কলেজে পড়ার সময়েই বিয়ে হয়ে গেল লীলার। পক্ষপাত কি এখানেও কম! মোটেও না। দূর্গাপুজোর পর একটা দিন, বাড়িতে মেয়ে জামাইদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। হিংএর কচুরি, আলুরদম, পায়েস ।অনেক ভালো ভালো খাবার হয়েছে। শাশুড়ি নির্দেশ দিয়েছেন। বৌরাই বানিয়েছে সব। খাবার সময়ে দেখা গেল, একটা কচুরিও জুটলোনা বৌদের কপালে। রাতে খেতে এসে লীলা দেখল তার আর বড় জা নীরুর ভাগ্যে জুটেছে আগের দিনের রুটি, আলুরদমের একটু ঝোল। পায়েস একটুও নেই। লীলা এসব মেনে নিলেও, ওর বড় জা নীরু মানতে চাইত না। মাঝেমধ্যেই নীরুর সাথে ঝগড়া বেঁধে যেত শাশুড়ির। কেন এরকম হবে! কেই বা উত্তর দেবে তার! সংসারে বৌদের সাথে এরকমই তো হয়ে এসেছে বরাবর। আর সেই বৌরা যখন শাশুড়ি হয়ে উঠেছে, তখন তাদের বৌমাদের উপর প্রয়োগ করেছে এসব।
কথায় বলে, সবার দিন সমান যায় না কখনো। এই সংসারেও একদিন পরিবর্তন এল। নীরু এখন এই পরিবারের সর্বেসর্বা। শাশুড়ি কে কোনঠাসা করে ফেলেছে একেবারে। নিত্য অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে লীলার স্বামী বাড়ি ছাড়তে চাইছিলেন। বড় তরফ তো সেটাই চায়। ছমাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছা না থাকলেও চলে যেতে হবে। পাগলের মতো বাড়ি খুঁজতে লাগলেন লীলার স্বামী, সুনির্মল ।কোথাও কোনো সুরাহা না করতে পেরে অবশেষে শ্বশুরের শরণাপন্ন হলেন।সুকুমারের বাড়ি একতলা। সামনে পেছনে অল্প খানিকটা জমি রয়েছে। সুনির্মল চাইলেন দোতলায় ঘর তুলে বসবাস করতে। বাপেরবাড়ি তে লীলারও তো একটা ভাগ আছে। সুপ্রিয় রাজি হল না। লীলা বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। সুকুমার বললেন, “কোর্ট যাই বলুক, এবাড়ির মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পায় না। অবশ্য মেয়ে যদি বিধবা হয়, তখন সে বাপেরবাড়িতে থাকতে পারে। নিতান্তই যদি থাকতে চাও, ঘর তুলে থাকতে পার, তবে ভবিষ্যতে ওই অংশটাও সুপ্রিয়র সন্তান পাবে। তোমাদের সন্তানের কোনো দাবি থাকবে না।” সরে এলেন সুনির্মল বাধ্য হয়ে।
পাঁচ বছর পর। সুপ্রিয় এখন বিবাহিত পুরুষ। এক ছমাসের কন্যা সন্তানের বাবা।
সুপ্রিয়র স্ত্রী অনুরাধার ইচ্ছা, স্বামীর এই পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে নিজের বাপেরবাড়ি তে চলে যাওয়া।”এখানে একা হাতে বাচ্চা সামলে সংসার করায় খুব কষ্ট। ওখানে মা আছে। অনেক সুবিধা।” সুকুমার বলেন,” মাত্র তো তিনজনের সংসার। এ আর কি আছে! তোমার শাশুড়ি মা তো সেই কবেই ইহলোক ছেড়েছেন” ।
“সেজন্যই তো বাবা। মা থাকলে তো এসব ভাবতেই হতো না”।
সুকুমার বাড়ি বিক্রি করার বিরোধী। এরপর সুপ্রিয়র শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ আসতে লাগলো। অনুরাধার বাবা সরাসরি বললেন, “আমি চাই, ভবিষ্যতে আমার অণু মায়ের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। সে জন্যই এই প্রস্তাব রাখছি। আমার মেয়ে জামাইকে আমার কাছেই রাখব আমি।আপনার বাড়িটা আপনি সুপ্রিয়র নামে লিখে দিন। এটা ওরা বিক্রি করে দেবে। টাকাটা কাজে লাগবে ওদের। বলা তো যায় না, আপনার মেয়ে যদি ভবিষ্যতে এই বাড়ি বা টাকার অংশ দাবি করে। তাই আমরা দুই বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে কাজটা সেরে দিয়ে যাই। ”
এই কাজটা করতে রাজি হননি সুকুমার। তার বদলে সহ্য করেছেন অকথ্য নির্যাতন ছেলে বৌমার হাতে। আর লীলা! শ্বশুরের ভিটেয় নিজের বাবাকে এনে তুলতে পারে নি। সে অধিকার দেওয়া হয়নি ওকে। সুকুমার মারা যাবার পর, ওই বাড়ি প্রমোটারের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সুপ্রিয়, সুকুমারের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে দেখিয়ে। সফল হয়নি। সুকুমারের এক শুভাকাঙ্খি এরপর বাড়িটা আইনি ভাবে সুপ্রিয় এবং লীলা দুজনের নামে ট্রান্সফার করিয়ে দিয়েছেন। মানে সুপ্রিয়র সাথে লীলাও এখন সমান ভাবে ওই বাড়ির অংশীদার। লীলাকে না জানিয়ে ওই বাড়ি বিক্রি করা যাবে না। এর ফলে লীলার বাপেরবাড়িতে পা রাখাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুঃখ নেই লীলার ।বাপ নেই, তো বাপেরবাড়ি কিসের । কিছু ই চায় না লীলা, বাড়ির ভাগ, টাকা পয়সা কিছুই না। শুধু বাবার ওই বাড়ি, অনেক স্মৃতি বিজড়িত ওদের সাত পুরুষের ওই ভিটে বিক্রি হতে ও কিছুতেই দেবে না।

——————————————–

Powered by themekiller.com