Breaking News
Home / Breaking News / কবি সুস্মিতা এর গল্প ” আগুন “

কবি সুস্মিতা এর গল্প ” আগুন “

#আগুন
#সুস্মিতা

আজ বাবা বলেছে মাইনে পাবে। বাড়ি ফেরার পথে বাবা তাহলে আজ ঠিক চাল কিনে আনবে, সঙ্গে চাচার দোকানের কয়েক টুকরো খাসির মাংস।

লেভেল ক্রসিংয়ের কাছেই বস্তির ঘরে শুয়ে দশ বছরের হাবুল সারাদিন শুধু ওই কথাই ভাবছে। ইশ কতদিন হয়ে গেল মাংস খায়নি ওরা। রোজরোজ এই একঘেয়ে আলুসেদ্ধভাত আর শাকভাত খেতে হাবুলের আর একটুও ভালো লাগেনা। কতদিন হয়ে গেল স্কুলটুল সব বন্ধ। গত দু বছরে কত মানুষ যে পটাপট মরে গেল। সবকিছুই যেন কেমন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাবুলের আজ আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

বাবাদের ফ্যাক্টরির মালিকটাও যেন কিরকম। কোনো মাসেই সে পুরো টাকা মাইনে দেয়না। কত সময় তো টানা দুতিন মাস বাবা কোনো টাকাই পায়না। কোনো কোনো মাসে আবার অর্ধেক। হাবুল শুনেছে কদিন আগেই বাবা দুঃখ করে দুলালকাকাকে এইসব কথা বলছিল।

এই টাকাপয়সা নিয়েই কত রাত পর্যন্ত মা আর বাবার ঝগড়াঝাটি হয়। গত তিন চার মাসে মা’র চার পাঁচটা বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাজগুলোও চলে গিয়েছে। এখন অনেকেই ভাইরাসের ভয়ে জ্বরের ভয়ে নিজেদের ঘরের কাজ নিজেরাই করছে, কাজের লোক আর রাখতে চাইছেনা। তার ওপরে ঘর পরিষ্কার করার, কাপড়কাচার, বাসন মাজার নিত্যনতুন মেশিন বেরোচ্ছে। মা আর মালতীমাসি এইসব বলাবলি করে। যে বিউটি পার্লারে মালতীমাসি কাজ করত সেটাও নাকি আর খুলবে না। লকডাউনের সময় এত লোকসান হয়েছে যে পার্লারের মালিক অন্য ব্যবসা করবে। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল মাসীটা।

মা তো সেদিন রাতে দুঃখ করে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলছিল- “এইবার তো মনে হচ্ছে “লাইনে” নামতে হবে।” কিসের লাইন কে জানে…। হাবুল বুঝতে পারেনি।

ছোট বোনটার জন্যও আজকাল আর দুধ কেনা হয়না। হাবুলও অনেকদিন হয়ে গেল দুধ খায়নি। কিছু ভালো লাগেনা ওর। সেই প্রত্যেকদিনই আলুভাতে আর একবেলা মুড়ি। তাও মা’র জন্য একেক দিন ভাত প্রায় থাকেই না। হাবুলের খুব কষ্ট হয়, কিন্তু ওর নিজেরও যে সবসময়ই পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে। ক্ষিদের সময় হাবুলের কারুর জন্য মনখারাপ হয়না, মা, বাবা, বোন কারুর জন্য না।কারুর কথা তখন ওর মনেই পড়েনা। ক্ষিদে পেলে ওর পেট জ্বালা করে, ওর কান্না পায়।

সেদিন বস্তির দীপুদাদা, বাপনদাদাদের দলটাও বস্তির একেবারে পেছনের ঝুপড়ি ঘরটায় জড়ো হয়ে এইরকমই কিসব বলাবলি করছিল। ক্ষিদের আগুন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার নাকি ক্ষিদের আগুন নেভানোর জন্য ওরা নিজেরাই নিজেদের কিসব ব্যবস্থা করবে। নতুন আগুন জ্বালবে। ঠিক পথ বের করে নেবে।

দীপুদা দু বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কতে লেটার পেয়েছিল। ওরে বাবা যেদিন রেজাল্ট বেরোলো সেদিন সন্ধ্যায় বস্তিতে কি আনন্দ। দীপুদাদার বাবা অনিলকাকা গোটা বস্তির লোককে ডিমের চপ আর জিলিপি খাইয়েছিল।
কাকার এখন হাতে কাজ নেই। ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করত কাকা। লকডাউনের সময় ওই দোকান যে কতদিন বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। ইদানীং আবার সেটা খুলেছে বটে, কিন্তু অনিলকাকার মতো আরও দুএকজন বুড়ো মানুষ আর কাজ ফিরে পায়নি।
দীপুদাদার পড়াশোনা তখন থেকেই প্রায় বন্ধ।
লকডাউনের সময় অনিলকাকা আর দীপুদাদা মিলে একটা ঠেলা জোগাড় করে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বিক্রি করত। কিন্তু সেভাবেও আর বেশিদিন টানা গেল না। বড় সংসার ওদের।

রফিকের বাবা লিয়াকত চাচা ময়দানের কাছে একটা ঘোড়ার গাড়ি চালাত। কি সুন্দর সাজানোগোছানো সেই গাড়ি। সেই গাড়িতে চেপে লোকজনেরা পুরোনো কলকাতার স্বাদ নিতো। সব কাস্টমার ওই গাড়িতে বসে আগেই পটাপট ছবি তুলতো ফেসবুকে দেবে বলে। লকডাউনের সময় সে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল।
তারপরে তো তিনমাস আগে লিয়াকত চাচাই কবরে চলে গেল।
রফিকরা পাঁচ ভাইবোন।
ঘরে বসে টেলারিংয়ের কাজ করে রাবেয়া চাচী। মেটিয়াবুরুজের দোকানে সাপ্লাই দেয়। কিন্তু একা চাচী পাঁচ সন্তানের ক্ষিদের আগুন আর নেভাতে পারে না। পাঁচটা স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরই এখন পড়াশোনার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক নেই।
বাপনদা, দিলুদা, টিয়াদিদি সকলেরই ঘরেঘরে একই গল্প।
স্কুল কলেজে কেউ যায়না। পেটভরে খাবার নেই, কাজকর্ম নেই। রোজগার নেই।

সেদিন ওই দাদাদিদিরা বস্তির শেষ ঘরটায় সবাই মিলিত হয়েছিল। সকলেই কিরকম উত্তেজিত, সকলেরই রক্ত গরম। বাইরের জানলা থেকে উঁকি দিয়ে হাবুল ওদের সব কথা বুঝতে পারেনি।

শুধু শুনেছিল দিপুদাদা বারবার বলছিল- “পেটের আগুন নেভাতে হলে, এবার অন্য আগুন জ্বালাতে হবে…হবেই। আর দেরি নয়, সময় হয়ে গিয়েছে।” ওরা অনেক অনেক মানুষের, অনেক নেতার মুখোশ টেনে ছিড়ে ফেলার কথা বলছিল।
বড্ড কঠিন সেসব কথা। সত্যিই সব কথার মানে হাবুলের মাথায় ঢোকেনি। শুধু আবছায়াভাবে ও বুঝেছিল- বস্তির ওই ঘরটা এবার হবে দিপু বাপনদের আগুন জ্বালানোর কারখানা। ওরা অস্ত্র বানাবে, অস্ত্র হাতে তুলে নেবে।

দশ বছরের হাবুল ভুল-ঠিক, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ অতশত গভীরভাবে বোঝে না। ও শুধু বোঝে, জানে, চেনে- “ক্ষিদে”…পেটে আগুন জ্বালানো প্রবল ক্ষিদে। আর ক্ষিদের সময় ওর নিজেরও মাথার ঠিক থাকে না, তখন ওর কারুর কথা মনে পড়ে না।

বাড়ি ফিরে সেই রাতে শুয়েশুয়ে হাবুল অনেক ভালোভালো খাবারের স্বপ্ন দেখল। স্বপ্ন দেখল- “একদিন বস্তির টিউবওয়েলের জলে ভালো করে স্নান করে ও ঘরে ঢুকবে, আর ঠিক তখনই মা ওকে এক বিশাল বড় থালায় গরম ভাত বেড়ে দেবে, সঙ্গে খাসির মাংসের বড় বড় টুকরো। সেদিন কিন্তু মা ওকে শুধু আলু আর ঝোল দিয়ে ভোলাবেনা…।”
উফ, ভাবতেই হাবুলের জিভে জল এসে যায়…

তারপর আজ সকালে কাজে বেরোনোর সময় বাবা বলে গেল- “আজ মনে হয় মাইনেটা ঠিক হয়ে যাবে, নিতাই খবর পেয়েছে।” সেই থেকে হাবুলের মনে উত্তেজনা। আজ বাবা ঠিক বেশি করে চাল আর খাসির মাংস আনবে…আনবেই। উফ কতদিন মাংস খায়নি ওরা। সকাল থেকে হাবুলের মনে আজ মাংসভাতের স্বপ্ন…।

স্বপ্ন নয়, বাস্তব
*************

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন…।দিগন্ত জুড়ে মায়াবী আলোর খেলা।
ঠিক তখনই…

“এই হাবুল শিগগিরই বাইরে আয়, কি কান্ড…তোর বাবা যে লাইনে কাটা পড়েছে।”- দুলালকাকার ডাক শুনে এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনার জায়গায় দৌড় লাগালো হাবুল। ও জানে “মাস-মাইনে”পেলে টাকাটা বাবা প্যান্টের কোথায় লুকিয়ে রাখে। পকেটমারের ভয় থাকে যে। ভীড় লোক্যাল ট্রেনে ফিরতে হয় তো…।

লাইনের ওপরে বাবার বডিটা কেমন বেকেচুরে পড়ে আছে। চারদিকে থকথক করছে রক্ত। বিনবিন করছে মাছি। হাবুলের তখন ওসব দেখার সময় নেই।
বাবার থেঁতলে পড়ে থাকা দেহের কাছে পৌঁছেই প্যান্টের চোরা পকেটে হাত ঢোকায় হাবুল।

ওর পেটে তখন ক্ষিদের আগুন জ্বলছে।

********

Powered by themekiller.com