Breaking News
Home / Breaking News / কবি নূরুল ইসলাম নূরচান’র ছোট গল্প “আলো আঁধারের জীবন”

কবি নূরুল ইসলাম নূরচান’র ছোট গল্প “আলো আঁধারের জীবন”

আলো আঁধারের জীবন

(ছোট গল্প)

নূরুল ইসলাম নূরচান

তারিখঃ ২৫/১০/২০২১
মানুষের জীবনে আলো-আঁধারের খেলা নিরন্তর। কখনো সুখ শান্তিতে আলোকিত হয় জীবন। আবার কখনও দুঃখে ভরপুর। তারপরও থেমে নেই জীবন।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর চাকরি জীবন শেষে অবসর নিয়েছেন সুবহান সাহেব। কর্মজীবনে খুবই সৎ ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাই কর্মজীবনে মোটামুটিভবে সংসার পরিচালনা করেছেন, বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারেননি।
তার দুটি সন্তান। একটি ছেলে আর অন্যটি মেয়ে। তারা মোটামুটি শিক্ষিত। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছেন। ছেলে সরকারি চাকরি করছেন। পাশাপাশি বিয়েও করে ফেলেছেন। তার ৮ বছরের একটি ছেলে রয়েছে।
সোহান সাহেবের জায়গা-জমি তেমন একটা নেই, অল্পস্বল্প যা ছিল তা বিক্রি করে এবং পেনশনের টাকা দিয়ে জেলা শহরে এক টুকরো জায়গা ক্রয় করে তার উপর দোতলা একটি বাড়ি করেছেন। সোহান সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হয়। তাই সে ছেলের সাথে একই বাসায় থাকেন।

ইদানিং ছেলে এবং ছেলের বউয়ের সাথে খুব বেশি কথাবার্তা হয় না তার। তবে নাতিনকে নিয়ে প্রায় সময়ই খেলায় মেতে থাকেন। তাদের মধ্যে গলায়-গলায় সম্পর্ক।

ছেলের বউকে সুবাহান সাহেব ‘মা’ বলে ডাকেন। কিন্তু বউ তার শশুরকে ‘মুরুব্বী’ বলে ডাকেন। ছেলে-বৌ’র সাথে ইদানিং আর এক টেবিলে বসে খাওয়া হয়নি সোবহান সাহেবের। তারা স্বামী-স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে খেয়েদেয়ে চলে যাবার পর টেবিলের মধ্যে খাবার রেখে যান বউ। সোহান সাহেবের ছেলের সাথে কথাবার্তা তেমন একটা হয় না। কারণ, ছেলে খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে অফিসে চলে যান, বাবার খোঁজখবর তেমন একটা রাখেন না।

ছেলে এবং বউয়ের আচরণে বোঝা যায় যে, সুবহান সাহেব যেন তাদের কাছে অতিরিক্ত বোঝা।

অবসর ভাতার টাকাটা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করার পর পরই ছেলে নিয়ে যায় বাবার কাছ থেকে। বলে যে, প্রয়োজনে আমার কাছ থেকে নিও চেয়ে। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে ছেলের কাছে টাকা চাইলে আর দিতে চান না ছেলে, দিলেও খুব সামান্য টাকা দেন বাবাকে।

ছেলে বউয়ের এমন অনাদরে অনেক কষ্ট হয় সুবাহান সাহেবের। কিন্তু তার করার কিছুই নেই। এমন আচরণের কারণে মাঝে মধ্যে কথাকাটাকাটি হয় ছেলে এবং ছেলের বউয়ের সাথে। মাঝেমধ্যে নাতিও তার বাবা-মার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললেন। কিন্তু সেও পেরে ওঠেন না তার বাবা মার সাথে। দিন দিন জীর্ণ-শীর্ণ হচ্ছেন সুবাহান সাহেব, গায়ে তেমন শক্তি নেই এখনো, ভেঙ্গে পড়েছেন অনেকটা।

এতসব দুঃখ কষ্টের মধ্যেও দাদা নাতির মধ্যে সম্পর্কের কোনো অবনতি হয় না। তারা সময় পেলেই একসাথে বসে গল্প গুজব ও খেলাধুলা করে।

শীতকাল। একদিন সন্ধ্যার পর পিঠা খাওয়ার আবদার করে নাতি। দাদা বললেন, ‘আমার কাছে তো টাকা নেই রে দাদু।’

নাতি বললেন, ‘আমার কাছে টাকা আছে, তুমি আমার সাথে চলো রাস্তার ওই মাথায় পিঠার দোকান আছে। ওখানে গিয়ে আমরা পিঠা খাবো।’ যে কথা সেই কাজ। তারা দুজন চলে গেল পিঠার দোকানে। সেখানে গিয়ে নাতি দোকানিকে বলল, ‘আমাদের দুজনকে দুটো ভাঁপা পিঠা দেন।’ দোকানি পিঠা দিলো, তারা দাদা নাতি পিঠা খেয়ে বাসায় চলে আসলাে।

সুবাহান সাহেব একবার খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আর তখনই ছেলে সেই আসল কাজটি করলো। অর্থাৎ স্ট্যাম্পে বাবার স্বাক্ষর নিয়ে শহরের জায়গাটুকু তার নিজের নামে দলিল করে নিয়ে নিলো। সুস্থ হওয়ার পর সুবাহান সাহেব সবই জানলো, শুনলো। কিন্তু করার কিছুই রইল না তার।

আগে মেয়ে এবং মেয়ের জামাই সোবহান সাহেবের খোঁজখবর নিতো মাঝে মধ্যে, তাদের বাসায় গিয়ে বেড়াতো। কিন্তু জমিটুকু হারানোর পর মেয়ে এবং মেয়ের জামাই আর তার খোঁজখবর নেন না।

সুবাহান সাহেব তার ছেলের রুমে গেলো, বলল, ‘রাজু আমাকে ২০ টি টাকা দাও।’

রাজু বলল, ‘টাকা নিয়ে কী করবা?’

বাবা বলল, ‘ নারকেল আর খেজুর গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা খাবো।’

ছেলে এক গাল হাসলো। বলল, ‘বাবা এসব আজেবাজে খাবার ছেড়ে দাও, অযথা টাকা নষ্ট করে লাভ কি?’

আর কথা না বাড়িয়ে সোবহান সাহেব চলে আসলেন। তার মনে পড়ে গেল অতীতের কথা। একবার দোকানে মিষ্টি দেখে তার খুব লোভ হয়েছিল। অতিরিক্ত টাকা নষ্ট না করে চারটি রসগোল্লা কিনে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তারা সদস্য সংখ্যাও ছিল মাত্র চারজন। সুবহান সাহেব তার স্ত্রী এবং দু ছেলে মেয়ে। সুবাহান সাহেব একটি রসগোল্লা খেতে বসেছিল কিন্তু সে সবটুকু খায়নি, সামান্য একটু খেয়ে বাকি অংশটুকু দু ছেলেমেয়েকে ভাগ করে দিয়েছিলেন।

হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার রক্ষণে বাসা থেকে নিখোঁজ সুবহান সাহেব। কোথায় আছেন, কোথায় গিয়েছেন? কেউ জানে না।

‘দাদু কোথায়, দাদু কোথায় গেছে?’ হাউমাউ করে কাঁদছে আর ডাকছে নাতি। কিন্তু সুবহান সাহেবের ছেলে-বউ’র মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারা নীরব নিশ্চুপ। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাত। নাতি দাদা দাদা বলে হাউমাউ করে কাঁদছে।

Powered by themekiller.com