Breaking News
Home / Breaking News / বিদায় হজের ভাষণ

বিদায় হজের ভাষণ

বিদায় হজের ভাষণ: দীনুল হকের সারসংক্ষেপ

…… ইয়াসমিন আক্তার

আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে তাঁর প্রত্যেক নবী-রসুল (আ.) কে পাঠিয়েছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্য দিয়ে তাহলো যার যার জাতির মধ্যে আল্লাহর তওহীদ ও তওহীদ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা, দীন প্রতিষ্ঠা করা। এরই ধারাবাহিকতায় শেষ নবীকে (দ.) পাঠালেন সমস্ত মানব জাতির উপর এই দীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। পূর্ববর্তী নবীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিল ছোট। কিন্তু এই শেষ জনের (দ.) দায়িত্ব হল এত বিরাট যে, এক জীবনে তা পূর্ণ করে যাওয়া অসম্ভব। অথচ যতদিন ঐ দায়িত্ব পূর্ণ করা না হবে ততদিন তাঁর উপর আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব অপূর্ণ-অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই তিনি (দ.) এমন একটি জাতি সৃষ্টি করলেন যে জাতিটি তিনি পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পরও তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তারই মত সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হল তার উম্মাহ-উম্মতে মোহাম্মদী- মোহাম্মদের (দ.) জাতি। তাঁর অবর্তমানে এই জাতি কিভাবে, কি কাজ করবে, কেমন চরিত্র অর্জন করলে শতগুন শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে জয়যুক্ত হবে তা তিনি এই জাতিকে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তারপর সময় এলো আল্লাহর কাছে চলে যাবার। আর এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি সর্বশেষ সমস্ত জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ বা দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটাই ইতিহাসে বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত।
কোন লোক যদি একটি মহান, বিরাট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা, অবিশ্বাস্য ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি সৃষ্টি করেন, তবে তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় তার সৃষ্ট জাতিটাকে কী উপদেশ দিয়ে যাবেন? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি তার শেষ উপদেশে সেই সব বিষয় উল্লেখ করবেন যে সব বিষয়ের উপর তার জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করবে এবং তার অবর্তমানে যে সব বিষয়ে জাতির ভুল ও পথভ্রান্তি হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তাই নয় কী? এবার দেখা যাক শেষ নবী (দ.) তার বিদায় হজে, যে হজ তিনি জানতেন তার শেষ হজ, তিনি তার জাতিকে কি কি বিষয়ে (Point) বলছেন। বিদায় হজ ছিল বিশ্বনবীর (দ.) জীবনের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। এতে তার ভাষণকে তিনি কতখানি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই থেকে যে অতবড় সম্মেলনেও খুশী না হয়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, যারা উপস্থিত আছেন তারা তার নির্দেশগুলি যেন যারা উপস্থিত নেই তাদের সবার কাছে পৌঁছে দেন- অর্থাৎ আরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, তাঁর সমস্ত উম্মাহ তা শুনুক, জানুক। এখন দেখা যাক কী কী ছিলো তার বক্তব্যে। আমরা পাই-
(১) এই উম্মাহর লোকদের পরস্পরের সম্পত্তি ও রক্ত নিষিদ্ধ, হারাম করা।
(২) আমানত রক্ষা ও প্রত্যার্পন করা।
(৩) সুদ নিষিদ্ধ ও হারাম করা।
(৪) রক্তের দাবি নিষিদ্ধ করা।
(৫) পঞ্জিকা অর্থাৎ দিন, মাস, বছরের হিসাব স্থায়ী করা।
(৬) স্বামী-স্ত্রী, নর-নারীর অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া।
(৭) “কোর’আন ও হাদীস” জাতির পথ-প্রদর্শক হিসাবে রেখে যাওয়া।
(৮) একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি-দেয়া নিষিদ্ধ করা।
(৯) কোর’আন ও রসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনকারী নেতার আনুগত্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া।
(১০) জীবন-ব্যবস্থা, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করা।
(১১) এই জাতির মধ্যকার শ্রেণীগত, ভৌগোলিক, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি সর্বপ্রকার ভেদাভেদ নিষিদ্ধ করা।
(১২) সম্পত্তির ওসিয়ত নিষিদ্ধ করা, অর্থাৎ আল্লাহ যে উত্তরাধিকার আইন দিয়েছেন তা লংঘন না করা।
(১৩) স্বামীর বিনানুমতিতে স্ত্রীর দান নিষিদ্ধ করা।
বিদায় হজের এই ভাষণটি পর্যালোচনা করলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে এগুলো আগে থেকেই কোর’আন হাদীসে ছিল। তারপরেও তিনি জোর দিয়ে গুরুত্ব সহকারে তাঁর জীবনের সর্বশেষ সমাবেশে এই নির্দেশনাগুলি আবারো জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তাঁর নির্দেশনাগুলির ছিল সবই জাতীয়, সামাজিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, একটিও পুরোপুরি ব্যক্তিগত ছিল না। সেই ভাষণে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে জাতির ঐক্য সম্বন্ধে তাঁর ভয় ও চিন্তা। এটা স্বাভাবিক, কারণ সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করে, শত নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করে, অপমান সহ্য করে, কাফের মোশরেকদের নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তিলে তিলে যে জাতিটিকে তিনি গড়ে তুললেন সেই জাতির উপর তাঁর কাজের দায়িত্ব অর্পন করে চলে যাবার সময় মানুষের মনে ঐ শংকায় বড় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ঐক্য ভেঙ্গে গেলেই সর্বনাশ, জাতি আর তার আরদ্ধ কাজ করতে পারবে না, শত্রুর কাছে পরাজিত হবে। তাই তাকে বিদায় হজের ভাষণে বলতে শুনি- হে মানুষ সকল! আজকের এই দিন (১০ই জিলহজ), এই মাস (জিলহজ) এই স্থান (মক্কা ও আরাফাত) যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অন্যের প্রাণ, সম্পদ ও ইজ্জত তেমনি পবিত্র (হারাম)। শুধু তাই নয় এই দিন, এই মাস ও এই স্থানের পবিত্রতা একত্র করলে যতখানি পবিত্রতা হয়, তোমাদের একের জন্য অন্যের জান-মাল-ইজ্জত ততখানি পবিত্র (হারাম)। “খবরদার! খবরদার! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করে কুফরী করো না” এই সাবধানবাণীটি তিনি একবার নয়, বার বার উচ্চারণ করেছিলেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যে, নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটিকে, অর্থাৎ জাতির ঐক্য নষ্ট করাকে নবীজী কোন পর্যায়ের মধ্যে ফেলেছেন? একেবারে কুফরের পর্যায়ে।
যাকে রসুলাল্লাহর কুফর বললেন, সেই কাজ এখন অতি উৎসাহের সঙ্গে করে যাচ্ছে তাঁর উম্মাহর দাবিদার মুসলিম নামক জনগোষ্ঠী। যাদের উপর দায়িত্ব ছিল পুরো মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করার, তারা নিজেরাই আজ পঞ্চাশটির মত ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত এবং শিয়া-সুন্নিতে, মাযহাবে মাযহাবে, ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তপাত করে রসুল বর্ণিত কুফরের মধ্যে বাস করছে। যে দীন নিয়ে বাড়াবাড়িকে রসুল নিষেধ করলেন তা আজ অতি সওয়াবের কাজ মনে করে করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও প্রতিবছর হজ করতে যাচ্ছে কোথায়? সেই জায়গায় যেখানে দাঁড়িয়ে নবীজী ঐক্যহীনতাকে কুফর বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কার্যত কাফেরে পরিণত হলেও এই মুসলিম দাবিদাররা হজের অতি সামান্যতম খুঁটিনাটি অতি যতেœর সাথে পালন করছে আর ভাবছে, তাদের হজ আল্লাহ কবুল করছেন, তাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করে রেখেছেন। তাদের ঐ আশা যে কতখানি হাস্যকর তা বোঝার ক্ষমতাও আজ এই জাতির নেই। সেদিন রসুলাল্লাহ (দ.) তাঁর অবর্তমানে যে যে বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন ঠিক সেই বিষয়গুলোই আজ এই জাতি করছে অতি সওয়াবের কাজ মনে করে। শিয়ারা সুন্নিদের আর সুন্নিরা শিয়াদের রক্তে হলি খেলছে। উভয় আশা করে তাদেরকে আল্লাহ এ কাজের জন্য খুশি হয়ে জান্নাত দান করবেন। জাতীয় জীবনে কোর’আন সুন্ন্াহর আইন সে তো এ যুগে কল্পনাও করা যায় না। কাজেই কোর’আনের সুন্নাহর পথে শাসনকারী আমীরের আনুগত্যেরও কোন বালাই নাই। যে সুদকে আল্লাহর রসুল মায়ের সাথে যেনার সঙ্গে তুলনা করেছেন, সেই সুদের ভিতরে এই জাতি আজ আপাদমস্তক ডুবে আছে। পঞ্জিকার কথা বলতে গেলে তো বলা যায় যে, এই জাতির যে নিজস্ব একটি পঞ্জিকা রয়েছে তা এদের অধিকাংশ সদস্য আজ জানেই না। এভাবে জাতীয়, সামাজিক, আইনগত, সকল বিষয়ে রসুলের আশংকাগুলোই আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাঁর সাবধান বাণীকে এই জাতি সামান্য পরিমাণ গুরুত্বও দেয় নি। এদের কাছে এটা কোন গুরুত্ব দেবার মত বিষয়ই নয়। এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দাড়ি, টুপি, মোজা, পাজামা, টাখনু, তসবীহ, তাহাজ্জুদ, কুলুখ, যিকের, ডান পাশে শোয়া, নফল নামাজ পড়া, রোযা করা, মেসওয়াক করা ইত্যাদি। এইগুলো করেই এই জাতি ভেবে রেখেছে যে জান্নাতের দরজা খুলে আল্লাহ তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ যে কতবড় নির্বুদ্ধিতা তা তারা ওপারে গেলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু তখন বুঝে কোন লাভ হবে না, তাই এপারে থাকতেই সকলের বোধদয় হোক-এ প্রার্থনা করে এখানেই ইতি টানছি।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

Powered by themekiller.com