বিশেষ প্রতিনিধিঃ
টাকার অভাবে কলেজে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে বাধ্য হচ্ছিল কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দুর্গম চরশৌলমারির মেয়েরা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্রের এই দুর্গম চরাঞ্চলে নারী শিক্ষার আলো ছড়াতে দুঃসাহসী উদ্যোগ নেন স্থানীয় যুবক হুমায়ুন কবির। সরকারি অনুদানের পরোয়া না করে নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন চরশৌলমারি আদর্শ মহিলা মহাবিদ্যালয়। হুমায়ুন নিজেই কলেজের অধ্যক্ষ। দুটি টিনের ঘরে আটটি ক্লাস রুম। ছাত্রীদের কারও বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই। উল্টো তাদের কিনে দিতে হয় বইপত্র। এমন দুস্তর প্রেক্ষাপটে হুমায়ুনের নেতৃত্বে নয়জন শিক্ষক ও সাতজন কর্মচারী চালাচ্ছেন কলেজের কার্যক্রম। শিক্ষকরা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে টিউশনি করে যে টাকা পান; তা ব্যয় করেন কলেজের ছাত্রীদের পেছনে।
নিবেদিতপ্রাণ এই শিক্ষকের সংগ্রামের খবর পেয়ে গতকাল বুধবার সকালে তাকে সরাসরি ফোন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি হুমায়ুন কবিরকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন।
মন্ত্রীর কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত সাড়া পেয়ে আবেগাপ্লুত হুমায়ুন কবির গতকাল সমকালকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর ফোনকল তার জীবনের সেরা অর্জন। যতই বাধা আসুক, তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস চালিয়ে যাবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম চরাঞ্চলে নারী শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির যে অবদান রেখে চলেছেন তা নজরে আসার পর নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সকাল ৯টায় তাকে স্বাগত জানাতে ফোন করেন। মন্ত্রণালয়ে আসার পথে গাড়িতে বসেই তিনি ফোন করেন অধ্যক্ষ হুমায়ুনকে। ওপাশে ফোন রিসিভ হওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি দীপু মনি বলছি। শিক্ষামন্ত্রী। কেমন আছেন?’
শুরুতে হুমায়ুন কবির বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সত্যিই শিক্ষামন্ত্রী তাকে ফোন করেছেন। নিজের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে চরশৌলমারি আদর্শ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের এই অধ্যক্ষ বলেন, সরকারের একজন মন্ত্রী এভাবে ফোন করে খোঁজ-খবর নেবেন তা কখনও আশা করিনি। তিনি (মন্ত্রী) আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনেন এবং সেগুলো সমাধানের আশ্বাস দেন।
নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ওই এলাকার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অধ্যক্ষ হুমায়ুন জানান, চরশৌলমারি চরের মেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পর টাকার অভাবে তাদের কলেজে যাওয়া হতো না। অধিকাংশ মা-বাবা তাদের সন্তানদের বিয়ে দিয়ে দিতেন। ঝরেপড়া এই ছাত্রীদের কথা ভেবে ২০১৩ সালে চরশৌলমারি আদর্শ মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন হুমায়ুন। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির একাডেমিক শিক্ষাদানের অনুমতি পেলেও সরকারি অনুদান বা এমপিও পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কয়েকজন বিত্তবানের অনুদান ছাড়া আর কোনো আয় নেই। যদিও অনুদানের টাকা পাওয়া হয় না নিয়মিত। শিক্ষকরা টিউশনি করে ছাত্রীদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। বর্তমানে এখানে পড়াশোনা করছে ৬০ ছাত্রী। তাদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হয় না। পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় অল্প কিছু টাকা নেওয়া হয়। তারপরও ছাত্রীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে ভর্তি করাতে হয়। এর পরও কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ভোকেশনাল কোর্স (বিএম) চালুর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান অধ্যক্ষ হুমায়ুন।
তিনি আরও জানান, ২০০১ সালে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইতিহাস বিভাগে ভালো ফল নিয়ে মাস্টার্স করেও নিজের ক্যারিয়ারের জন্য চাকরির পেছনে ছোটেননি। নিজ এলাকায় নারী শিক্ষার প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ হুমায়ুন বলেন, অবহেলিত ছাত্রীদের শতভাগ উপবৃত্তি ও আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক। গ্রামে বসে একটা মেয়ে যেন সর্বোচ্চ শিক্ষা নিতে পারে সে জন্য নিজের প্রতিষ্ঠানে অনার্স, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স কোর্স চালুর ব্যাপারেও সংশ্নিষ্টদের সাহায্য চান হুমায়ুন।