বিশেষ প্রতিনিধিঃ
ভৌগোলিক অবস্থান ও বদ্বীপপ্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি-৫) তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ছয়টি দুর্যোগপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। আগামী শতকগুলোয় বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য বন্যা, খরা, সাইক্লোন, লবণাক্ততা— এগুলোর ঝুঁকি বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় পরিবেশগত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্প উন্নয়নের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর ক্রমে চাপ বাড়ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা ও দেশের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ বাস্তবতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে সহায়তার জন্য প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০।
জাতীয় উন্নয়নে পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ, প্রতিবেশগত ভারসাম্য, কৃষি, ভূমি ব্যবহার এবং অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ একটি অভিযোজনভিত্তিক, সামগ্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মহাপরিকল্পনা। জলবায়ু পরিবর্তন ও তার ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০তে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাছাড়া পানি ও পরিবেশবিষয়ক লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে এ পরিকল্পনায় আরো সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্টকরণ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান এ দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ শতাংশ ও ২০৭৫ সালের মধ্যে ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪ শতাংশ এলাকা বন্যা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সাইক্লোনের মাত্রা ও গতি ৫-১০ শতাংশ বাড়তে পারে। এসব উপাদান দ্বারা দেশের অধিকাংশ খাত প্রভাবিত হয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ক্ষতি সাধন করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত হলো কৃষি। উচ্চতাপমাত্রা আউশ, আমন ও বোরো ধানের উচ্চফলনশীল জাতের ফলন হ্রাস হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বিকিরণ কীটপতঙ্গ, রোগ-জীবাণু ও অণুজীবগুলোর বৃদ্ধি ঘটায়। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি থেকে বেড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা একটি ভয়াবহ বার্তা। সবকিছু অক্ষুণ্ন রেখে যদি দেশের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পায়, তবে ধানের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৬১ শতাংশ কমে যাবে। ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালের মধ্যে ২০০২ সালের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন হ্রাস পাবে। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকায় ধানের ফলন কমে গেছে। বিশেষত পটুয়াখালী জেলার ধানের গড় ফলন জাতীয় গড়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ এবং নওগাঁর তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। সহনীয় পর্যায়ের জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যকল্পে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের কারণে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হচ্ছে। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, স্থিতাবস্থা পরিস্থিতিতে ফলন হ্রাসের ফলে বার্ষিক ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২১০০ সালে আরো ৫ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পুনঃপুন বন্যায় কৃষি খাত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ খাত হচ্ছে বনাঞ্চল ও প্রতিবেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, উচ্চতাপমাত্রা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে দেশের বনসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জলবায়ু-সংবেদনশীল অনেক প্রজাতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অনেক উঁচু বনভূমি এলাকায় মাটি ক্ষয় ও এর গুণগতমান হ্রাস পাবে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লোনা পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাবে, যা বন ও এর বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্লাবনের ফলে ভূমি ও ভৌত কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্থলভূমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্থায়ীভাবে প্লাবিত হবে; জমির পরিমাণে আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণে অর্থনীতির সব খাতে উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং প্রকৃত জিডিপিতে অবনমন ঘটবে। স্থিতাবস্থা পরিস্থিতিতে ২০৩০