Breaking News

ছাত্রলীগের এমন ‘ম্যাচুরিটি’ সত্যিই প্রশংসনীয়!

বিশেষ প্রতিনিধিঃঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টক অব দ্যা ক্যাম্পাস’ এখন ডাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় পর এই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার একটি দারুণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আদৌ হবে কিনা সেটি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যদিও। ইতিপূর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল দুয়েকবার, শেষ পর্যন্ত সেসব আলোর মুখ দেখেনি।

এবার আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সাথে মত বিনিময় করছে। সংগঠনগুলোও নিজেদের মতামত সুপারিশ করছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক হাওয়া বইতে শুরু করেছে চারদিকে। আর এমন বাস্তবতায় সামনে আসছে সবগুলো ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানের বিষয়টি৷ আর ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে সহাবস্থানের প্রশ্নে উদার হতে আপত্তি নেই ছাত্রলীগের। গতকাল ছাত্রলীগের তরফ থেকে এই বিষয়টিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি, সেটি বর্তমান ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ম্যাচুরিটি বৃদ্ধিরই একটা শুভ ইংগিত বলে মনে করা হচ্ছে।

ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদে ডাকা হয় ক্যাম্পাসে ক্রীয়াশীল সকল ছাত্রসংগঠনকে। সভায় ১৩টি সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা অংশ নেন৷ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান বেশ সুসংহত। তবে মধুর ক্যানটিনে বিভিন্ন বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনকেও সক্রিয় দেখা যায়। বাম সংগঠনগুলোর কর্মীসংখ্যা কম হলেও ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ইস্যুতে তারাও বেশ সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু, একসময়কার অন্য আরেকটি বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ বেশ ক’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের লক্ষণীয় কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

সাংগঠনিক দূর্বলতা এবং রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপের কারণে বাজে ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় ছাত্রদল রাজনৈতিকভাবে এখন আর আগের অবস্থানে নেই। এছাড়া ছাত্রসংগঠন নামে হলেও কার্যত তাদের নেতৃত্বের মধ্যে ছাত্রত্ব কিংবা ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবার যে তারুণ্য, দুটোই অনুপস্থিত। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে ছাত্রদল ছাত্রদের সংগঠন হয়ে কাজ করতে পারবে কিনা কখনো, পেট্রোল বোমা কিংবা এ জাতীয় কেলেঙ্কারি পরিহার করে তারা ছাত্র হিসেবেই রাজনীতি করবে কিনা এগুলো বড় প্রশ্ন। এইসব সংশয় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে হবে ছাত্রদলকেই।

ছাত্রদলকে যেমন সুস্থ রাজনীতি দিয়েই রাজনীতির ধারায় ফিরতে হবে তেমনি তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনীতির মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হবে। এই জায়গাটাই অনুপস্থিত ছিল এতদিন। আমরা লক্ষ্য করেছি, এই দুইটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারে না। ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ঢুকতে পারে, শুধু এমন তথ্যেও ক্যাম্পাসের পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়, একটা ধুন্ধুমার কিছু হবে এমন একটা অবস্থার তৈরি হয়। ছাত্রদলও অতীতে নিজেদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একই কাজ করেছে।

এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্মই হয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে রেষারেষির কারণে। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষে বিভিন্ন সময়ে কত ছাত্রের প্রাণও হারাতে হয়েছে একসময়। সেই বিভীষিকার দিন কি আবার ফিরে আসবে কিনা? বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ কি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় হিংস্রতার আশ্রয় নেবে কিনা? এমন একটা সংশয় ছিল সবার মনে। এই জায়গাটাতেই ছাত্রলীগ ম্যাচুরিটির প্রমাণ রাখলো এবার। ক্ষমতার দম্ভ না দেখিয়ে উদার পথেই হাঁটবার অঙ্গীকার ছাত্রলীগের।

পরিবেশ সংসদের আলোচনা শেষে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুলকে পাশে নিয়েই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পাশে রেখে এভাবে কথা বলাটা সৎ সাহসের ব্যাপার। গোলাম রাব্বানি খুব স্পষ্ট করেই বললেন তারা সত্য সুন্দরের পক্ষে থাকবেন। ছাত্রদলের কর্মীদের যারা বৈধ ছাত্র তারা যদি সহবস্থান করতে চায় এতে আপত্তি নেই ছাত্রলীগের। তবে অতীতের কুকর্মকে পেছনে ফেলে আসতে হব।

অবশ্য একই কথা তিনি গতবছর সেপ্টেম্বরেও বলেছিলেন। তখন প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নিয়ে আলোচনার জন্য সব সংগঠনকে আমন্ত্রণ করে। সেই আলোচনায় আবার ছাত্রদলের পক্ষ থেকে দুইজন গিয়েছিল। আলোচনা শেষে যখন ছাত্র সংগঠনের নেতারা বের হচ্ছেন তখন দেখা গেল বাইরে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী। আর ছাত্রদলের মাত্র ওই দুজন। ছাত্রদলের ওই দুই নেতাকে তখন নিরাপদে বের করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। ছাত্রদলের দুই নেতাকে ঘিরে ছাত্রলীগের নেতারা। ছাত্রদলের দুই নেতার মধ্যে ছিল আতঙ্ক। বারবার তারা পেছনের দিকে দেখছিল। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়রে নেতারা ঘিরে রেখেই ছাত্রদলের দুই নেতাকে রেজিস্ট্রার ভবন থেকে বের করে আনলেন। এরপর সেখানে বিদায়ী আলাপের মধ্যেই ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসানকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। গোলাম রাব্বানী তখন বলেছিলেন, ছাত্রদলের পকেটে পেট্রোল বোমা থাকলে এই সহনশীলতা, সহ-অবস্থান থাকবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায়, গণমাধ্যমে এই ঘটনা বেশ আলোচিত হয়।


বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি যে হয়েছে সেটা স্পষ্ট ছাত্রদল নেতা আকরামুল হাসানের কথায়। গতকালের সভার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ডাকসু নির্বাচন ঘিরে বিগত দুটি সভায় যোগ দিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের নিরাপত্তা নিয়ে এসেছিলাম৷ আজকে (গতকাল) সেটি প্রয়োজন হয়নি৷ যদি সত্যিকার অর্থেই সহাবস্থান নিশ্চিত হয়, সেটি স্বীকার করতেও আমাদের দ্বিধা নেই৷”
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেম, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ৩০-৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ৷ বাকিরা সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মী ৷ ছাত্রদলের নেতাদের প্রতি অনুরোধ, হলগুলোতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের যেসব নেতা-কর্মী রয়েছেন, তাঁদের তালিকা তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিক ৷ কথা দিচ্ছি, ছাত্রদল নেতা-কর্মী পরিচয়ে কোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী হলে থাকলে আমরা কোনো ধরনের সমস্যা করব না৷”
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের কণ্ঠে যতটা উদারতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে, তাতে এইটুকু স্পষ্ট যে বর্তমান ছাত্রলীগ কমিটি রাজনীতিটা করতে জানে। এই ছাত্রলীগের ম্যাচুরিটি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতার দম্ভ নয়, বরং ইতিবাচক ধারার রাজনীতির পক্ষে যে বার্তা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে সেটি বেশ চমৎকার। এই স্মার্ট রাজনীতিটাই ছাত্রলীগের কাছ থেকে দেখতে চায় সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তমত চর্চার কেন্দ্র হবে, সকল শান্তিপ্রিয় ছাত্রসংগঠন সুস্থ রাজনীতির চর্চা করবে, সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে কাজ করবে, বৈরিতা বা সংঘাত দিয়ে নয় রাজনীতি দিয়ে তারা জয় করে নেবে সবার মন এইটুকুই তো চাওয়া সবার। আর এজন্যে যে রাজনৈতিক ম্যাচুরিটির দরকার, তার একটা ঝলক দেখা গেল ছাত্রলীগের বর্তমান অবস্থানে। এই শান্তির পতাকা উড়তে থাকুক।

Powered by themekiller.com