ছোটগল্প–কলঙ্কিত অধ্যায়
Writer MD Moidul Islam
তিতলি গর্ভবতী হলো কী করে এই নিয়ে এখন আমাদের সবার মাথা খারাপ। নাওয়া, খাওয়া, শোয়া সব শেষ!
ভাবতে পারেন! সবে মেয়েটা মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। আর এর মধ্যে এই? তাছাড়া সব থেকে বড় কথা মেয়েটার এখনও বিয়েই হয় নি। আমাদের সমাজের জন্য একজন অবিবাহিতা কিশোরী মেয়ের গর্ভসঞ্চার হওয়া যে কতটা চিন্তা-উদ্রেককারী ও বিড়ম্বনার বিষয় তা আশা করি আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না।
আমরা তিতলিকে যতটুকু জানি যে অত্যন্ত পরহেজগার মেয়ে। আর পাঁচটা মেয়ের মত সে অতটা চ্যাকচেকে স্বভাবের নয়। শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র ও লাজুক মেয়ে। কেউ কেউ আবার বলে থাকে এই ধরণের মিষ্টি মুখো মেয়েরাই নাকি কঠিন বদ হয়ে থাকে। এরা উপর উপর ভেজা বিড়াল হয়ে থাকে কিন্তু তলে তলে জড় কাটে। তাহলে কি তিতলিও সেই রকমই কিছু করেছে? তিতলির মা অর্থাৎ আমার খালাম্মা এমনকি আমার মা’রও তিতলির সম্পর্কে এই রকমই ধারণা ।
কথা খুলে না বললে বুঝতে পারবেন না। তিতলির বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে খালামার একান্ত ইচ্ছা তিতলির বিয়ে আমার সাথে দেওয়ার। তিতলিকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমার নিজস্ব কোনো ফিলিঙস্ ছিল না। তাকে আমার পছন্দ নয় এমনও নয় – আবার তাকে আমার ভালো লাগেনা এমনও নয়। কিন্তু আমার মা তখন এমন বেঁকে বসে যে এই নিয়ে প্রায় পাঁচ-ছ মাস মা’র সাথে খালাম্মার কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে যায়।
অনেকদিন পর সেই কথা বলা ঘটনাক্রমে যদি বা শুরু হল তো কঠিন এক দুঃসংবাদ দিয়েই শুরু হল- কিনা তো তিতলি এখন গর্ভবতী।
এখন খালাম্মা আমার মাকে চাপ দিতে শুরু করেছে তিতলির সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। এতকাল আমার মা তিতলির সঙ্গে বিয়ের কথা বললে যেন বমি করে ফেলবে এমন ভাব করত সেই মা এখন এই বিয়েকে সাপর্ট করতে শুরু করেছে। জানিনা খালাম্মা মাকে কিভাবে কনভেন্স করল!
শুনেছি খালাম্মা নাকি মাকে বলেছে তিতলির ঐ কান্ড আমার দ্বারাই হয়েছে! নাউযুবিল্লাহ নাউযুবিল্লাহ। অন্তত আমার মা আমার ব্যাপারে এত নোংরা চিন্তা ভাবনা মাথায় আনল কী করে আমি ভাবতে পারছি না। এখন এই ব্যাপারটাই হয়েছে আমার কাছে সব থেকে কষ্টের, সব থেকে যন্ত্রণার- যা আমি কাউকে বলতেও পারছি না। আবার মুখ বুজে সহ্য করতেও পারছি না।
এমনিতে তিতলিকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু এমন অপবাদ ও কলঙ্কের কালি মুখে মেখে নিয়ে, আমার সমস্ত আত্ম সম্মানকে খুইয়ে দিয়ে বিয়ে করার বান্দাও আমি নই। কঠিন জেদ চেপে বসল আমারও।
তিতলির ব্যাপারে মা’র আমাকে সন্দেহ করার একটা ক্লু কিন্তু আছে। আর সেটা একেবারেই অমূলক নয়। সেটা হল তিতলি যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় তখন পরীক্ষার পরে যে তিন মাস অবকাশ ছিল তখন সে আমাদের বাড়িতে এসে প্রায় এক মাস মত ছিল।
তখন সে কম্পিউটার শেখার জন্য খুব বেশি বেশি সময় আমার রুমেই থাকত। এদিকে আমার দিনের বেলায় অফিসের ডিউটি থাকায় আমি রাত ন’টা দশটার দিকেই সময় পেতাম তাকে কিছু শেখাবার। কোনো কোনো দিন তো রাত এগারোটাও হয়ে যেত।
এখন দেখছি নিজের মাও এই টা বিশ্বাস করতে পারেনি যে একটা জোয়ান ছেলে রাত ন’টা-দশটার দিকে লাগাতার তার রুমে একটা উঠতি যুবতি মেয়েকে রোজ রোজ একান্ত নির্জনে পাবে অথচ কোনোদিন কিছু করবে না!
এখন আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি কেন দ্বীনের নবী মুহাম্মাদ সঃ দু’জন যুবক যুবতীকে একান্ত নির্জনে(খুলুয়াতে সহীহাহ্) অবস্থান করতে নিষেধ করেছেন।
ভুল তো যা হওয়ার হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আমি উদ্ধার হই কী করে। এই চিন্তায় আমার মাথা ভো ভো করছে সারাক্ষণ।
প্রকৃত সত্য ঘটনাটা যে কী ঘটেছে তা আর কেউ জানুক না জানুক তিতলির তো জানার কথা- নাকি? সে কেন মুখ খুলছে না? তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কেমন দায়সারা গোছের উত্তর দিচ্ছে। সে বলছে-‘ কীভাবে কী হয়েছে আমি কিছু বলতে পারবনা – আমার অনেকদিনই এই রকম হয়েছে যে আমি কম্পিউটার শিখতে শিখতে সেলিম ভাইয়ার(আমার) রুমে ঘুমিয়ে পড়তাম-কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমি অন্য রুমে শুয়ে আছি। আমাকে ঘুমের ঘোরে কিছু না করলে এটা কী করে হত?’
দেখেছেন মেয়ের কথা-বাত্রা! একটা ভালো মানুষকে সন্দেহ মুক্ত হতে না দেওয়ার জন্য কীভাবে কথা বলা দরকার সেটা কিন্তু সে ভালোই জানে! ঠিক এই জায়গা বা পয়েন্ট থেকেই আমার মা আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।
আমি নিজেকে সামাল দিতে পারলাম না রাগে। এত বড় অপবাদ দেওয়া হচ্ছে আমাকে? যদিও ব্যাপারটা এখনো পাঁচকান হয়নি। আমি তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম সোজা তিতলিদের বাড়ি। তিতলিদের বাড়িতে গিয়ে শুনছি তিতলি বাড়িতে নেই। মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল। খালাম্মার মুখও বিষ বিষ হয়ে আছে। আমাকে তো কথা বলতে লজ্জা লাগছেই তবুও জিজ্ঞাসা করলাম তিতলি কোথায় খালাম্মা?
-‘সে তো বাড়িতে নেই!’
-‘কোথায় গেছে? কখন আসবে?’
-‘কি জানি – ওর আবার কী হল! গত শনিবারই চলে আসবে বলে গেল – কিন্তু আজও আসল না।’
-‘কোথায় গেছে ও!’ খুবই অবাক ও বিষ্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম আমি।
খালাম্মা কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব করছে আমার সাথে কথাগুলি বলার সময়।
আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম –‘তিতলি কোথায় গেছে খালাম্মা?’
-‘ও গেছে বৃন্দাবনপুরে ওর সেই ফুপুর জা’ এর মামা শ্বশুরের ভাই এর বাড়ি।’
-‘ওখানে কেন? ওর মামা শ্বশুরের ভাই এর নাম কী?’ বেশ রাগতভাবে জানতে চাইলাম আমি। এত দূর সম্পর্কের কারো বাড়ি যাওয়া, তার পরে আবার কয়েকদিন সেখানে থেকে যাওয়া এটাই আমার কাছে আপত্তিজনক।
-‘লোকটার নাম মতলব আলি- তিতলি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ওর বাড়ি থেকেই তো পরীক্ষা দিয়েছিল- সেই সুবাদে ওদের সাথে একটা কুটুম্বের সম্পর্ক হয়ে গেছে।’
-‘তাই – বাঃ বেশ ভালো।’
-‘তিতলিকে ওরা খুব ভালোবাসে- পরীক্ষা দিয়ে চলে আসার সময় পাঁচ হাজার টাকা দামের সালোয়ার কামিজ দিয়েছিল।’
আমি মনে মনে ভেবেই নিলাম এইখানে কিছু একটা ঘাপলা থাকলেও থাকতে পারে। আমি খালাম্মাকে বলে সোজা রওনা দিলাম বৃন্দাবনপুরের উদ্দেশ্যে- সেই মতলব আলীর বাড়ি।
দ্রুত গতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম বৃন্দাবনপুরের সেই মতলব আলীর বাড়ি। আগের যুগের বুনিয়াদী পরিবারের বাড়ির মত ধাচ। বাংলা ইঁট দিয়ে খিলান করা ডিজাইন।
আমি বাড়িটির গেটের কাছে যেতেই একজনকে দেখলাম আমার সামনে দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেল- যেভাবে পুলিশকে দেখে চোরে পালায়।
অমনি বাড়িটার দোতলার সিড়ে বেয়ে একেবারে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার এসে তিতলি আমার পা ধরে পড়ে গেল!
-‘আমাকে বাচান ভাইয়া, আমাকে বাচান!’
-‘কী হয়েছে তিতলি? এখানে কেন তুমি?’ বললাম আমি।
-‘সব ঘটনা পরে খুলে বলব – আমাকে বাঁচাতে হলে আগে আপনি আমাকে এখান থেকে এখুনি নিয়ে চলুন!’ এমন বিস্ময়ের সঙ্গে হাঁফাতে হাঁফাতে কথা বলল তিতলি যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
-‘চলে যাবে তো এদেরকে একটু বলে যাবে না?’ বললাম আমি।
-‘আপনি চলেন তো!’ এ কথা বলেই তিতলি আমার হাত ধরে কষে একটা হ্যাচকা টান দিল।
আমি তাকে আমার গাড়ির পেছনে বসিয়ে নিয়ে দিলাম টান।
বেশ কিছুক্ষণ তিতলি মুখ বন্ধ করে চুপ করে থাকল-কোনো কথা বলল না।
একটু পর তিতলি বলল- ‘ ভাইয়া আপনি ওখান থেকে আসতে আর একটু দেরি করলে বিরাট বিপদ হয়ে যেত। আপনার সামনে দিয়ে যাকে দৌড়ে পালাতে দেখলেন সে আসলে দৌড়ে পালায়নি – সে আসলে দৌড়ে গিয়েছে তার দলবলকে ডেকে আনতে আপনার উপর আক্রমন করার জন্য- আপনাকে মেরে ফেলত।’
-‘আমার উপরে তার কেন এত রাগ? কে সে? আমি তার কী করেছি?’ বললাম আমি।
-‘ভাইয়া এখন আমি আপনাকে সব কথা বলে বোঝাতে পারব না- আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন। বলা যায় না ওরা আমাদের পেছনে তাড়া করতে পারে-একটু জোরসে চালান।’
আমার তিতলির কথা বাত্রা কেমন অসংলগ্ন ও অস্বাভাবিক বলে মনে হল। তবু তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলাম- একটু স্পীডেই।
কিছুক্ষণ পর খালাম্মার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম। মাগরিবের আজান হচ্ছে মসজিদে। আমি তিতলিকে বললাম-‘আমি মসজিতে নামাজ পড়ে আসছি তুমি বাড়ি চলে যাও।’
তিতলি চলে গেল।
আমি মসজিদে নামাজ পড়ে খালাম্মার বাড়ি ঢুকেই দেখছি আরেক কান্ড। দেখলাম তিতলি বারান্দায় চিৎপাট হয়ে শুয়ে আছে। খালাম্মা তার মাথায় চুপচাপ পানি ঢালছে আর ফুস ফুস করে কান্না করে চলেছে। চিল্লায়া কাঁদতে পারছে না। আশপাশের বাড়িগুলি থেকে বৌ-ঝিরা এসে তিতলি একটু আগে কেন অজ্ঞান হয়েছিল এটা জানতে চায়লেই তো বিপদ।
-‘ও তো ভালোই আসল খালাম্মা –এই দশ মিনিটের মধ্যে আবার কী হল!’ জানতে চাইলাম আমি।
-‘ও এসেই ওর টাচ ফোনে কী দেখছিল , আর দেখতে দেখতেই অমনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল!’
দেখলাম ওর পাশেই পড়ে আছে টাচ ফোনটি। স্ক্রীনে একটা ভিডিও চলে চলে থেমে গেছে। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভিডিওটা প্লে এগেন করলাম।
দেখলাম লোম হর্ষক ঘটনা। বৃন্দাবনপুরের সেই ছেলেটা, যে আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল । সে প্রথমে তিতলি যে ঘরে শুয়ে ছিল সে ঘরে তার মাথার কাছের একটি জানালা দিয়ে ঘুম পাড়ানি ঔষধ স্প্রে করল। তারপর তিতলি অজ্ঞান হয়ে গেলে সে তিতলির রুমে ঢুকল। তিতলিকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করল। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তিতলিকে বিভিন্ন কায়দায় ধর্ষণ করল। শুধু সেই নয় পরপর তিন জনকে দেখা গেল ঐ একই কাজ করতে!
তিতলির জ্ঞান ফিরে একটু কথা বলার মত হলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিতলি তুমি এই ভিডিও পেলে কোথায় ? কি করে? তিতলি তখন বলল-‘সেই ছেলেটা নিজেই তার মোবাইলে আমাকে ঐ ভিডিও দেখায়- আর এটা দেখিয়েই সে আবার গত তিন দিন থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে। ঐ নোংরা ভিডিও গুলি সে ধারণ করেছে চার মাস আগে -যখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ওদের বাড়িতে এসে প্রায় পনের দিন ছিলাম। গতকালকে আমি অনেক কষ্টে সারা রাত একটুও না ঘুমিয়ে জেগে ছিলাম সুযোগের অপেক্ষায়। তারপর ও বাথরুমে যেতেই ওর ফোন থেকেই সেই নোংরা ভিডিওগুলির কয়েকটিকে আমি আমার গুগল ড্রাইভে সেভ করে ফেলি।’
সব কথা শুনে এবার খালাম্মা তার কান্না আর চেপে রাখতে পারল না। আমার হাত ধরে হুহু করে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল!