মনু নদীর মাঝি
– দেবাশীষ দাস
– অক্টোবর ১৫, ২০২১
সতীর্থরা কলেজে চলে যাবার পর শারদ উৎসবে আমার শহোচারি ছিল রুপন। সে বয়সে আমার থেকে বছর তিনেক ছোট ছিল। কিন্তু দুজনের মধ্যে বেশ কিছু আনুরূপ্য ছিল। দুজনেই ছিলাম শিক্ষিত ও ভদ্র ছেলে। অন্যান্য সময় অসংখ্য বন্ধু থাকলেও দুর্গা পুজোর সময় দুজনেই একা। দুজনেরই মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করার সাধ্য ছিল না। দুজনেই সুরা পানে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা দুজন ছিলাম অন্য সব বন্ধুদের থেকে একটু আলাদা। আমরা দুজনে ছিলাম একে অপরের পরিপূরক। তাই আমরা একসাথে পুজো দেখতে যেতাম।
একবার সপ্তমীর সন্ধ্যায় আমরা দুজনে মনু নদীর ওপারে ঘাগরাছড়ায় পুজো দেখতে যাচ্ছিলাম। ছৈলেংটা বাজারের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মনু নদী। ওপারে যাবার জন্য তখন পাকা সেতু ছিল না। নদী পারাপারের মাধ্যম ছিল নৌকা। খেয়াঘাটে গিয়ে দেখতে পেলাম ওপার থেকে যাত্রী নিয়ে নৌকো আসছে। তীরে এসে নৌকো থামলে মাঝি বললেন আগে নৌকার যাত্রীরা সবাই নামবে, তারপর নতুন যাত্রীরা নৌকোয় উঠবে। আমরা দুজনে মাঝির কথায় কর্ণপাত না করে সুযোগ বুঝে নৌকোয় উঠে পড়লাম, মাঝি সেটা খেয়াল করেন নি। সব যাত্রীরা নেমে যাবার পর আমরা দুজন নৌকায় দাঁড়িয়ে। মাঝি বললেন তাড়াতাড়ি নেমে যাও ওপারের যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। রুপন বলল আমরা ওপারে যাব। এটা শুনে মাঝি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমার অনুমতি ছাড়া তোমরা নৌকোয় কেন উঠেছ!’ আমরা তখন নৌকো থেকে নেমে যাচ্ছিলাম। মাঝি বললেন, ‘যাচ্ছ কোথায় ? একবার আমার অনুমতি ছাড়া নৌকায় উঠেছ, আবার অনুমতি ছাড়া নেমে যাচ্ছ, কি ভেবেছ সবকিছু তোমাদের ইচ্ছেমত হবে! উঠে যখন পড়েছ তখন ওপারে না গিয়ে নৌকা থেকে নামতে পারবে না।’ আমরা দুজনে পড়লাম মহা বিপদে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঝি অন্যান্য যাত্রীদের বললেন যারা যারা ওপারে যাবেন উঠে পড়ুন। ওপারের কিছু নিত্য যাত্রী এবং পুজো দেখতে যাওয়া কিছু যাত্রী নৌকায় উঠলেন। তারপর নৌকা ওপারের দিকে যাত্রা শুরু করল। মাঝি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন বাবুদের মানে লেগেছে বুঝি! আমার প্রথম কথাটা কানে গেল না, পরের কথাটা মানে লেগে গেল! সোনার চাঁদ আমার, দেখতে তো দুজনকে সিনেমার নায়কের মত লাগছে। কিন্তু কাজ তো ভিলেনের মত করেছ। তা তোমরা কি সত্যি সত্যি নিজেদেরকে সিনেমার নায়ক ভাবছ নাকি! দেখ বাপু আমি সাধারণত যাত্রীদের নদী পারাপার করি, আমার নৌকায় নায়ক নায়িকাদের উঠতে দিই না। তোমরা আগেভাগে ওঠে পড়েছিলে বলে নিয়ে যাচ্ছি, নইলে তোমাদেরকে নৌকোয় পা রাখতে দিতাম না!
এপার থেকে ওপারে যেতে যেতে মাঝি ভাই এভাবেই আমাদেরকে গালমন্দ করে গেলেন। আসলে বিলেতি তরলের গুনে মাঝি ভাই ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে। নৌকার অন্যান্য যাত্রীরা কোনও কথা বললেন না। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। মাঝি ভাই একাই বকবক করে গেলেন। আমাদের দুজনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম কী কুক্ষণে যে ঘাগরাছড়া রওয়ানা হয়েছিলাম! আমরা দুজনে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। নৌকায় চড়ে মাঝির সাথে তর্ক বিতর্ক করা মানে জলে দাঁড়িয়ে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করার মত। তাছাড়া মাঝি ভাই যে মেজাজে আছেন তাতে আমরা একটা কথা বললে তিনি আরো একশোটা কথা বলবেন। এতে আমরা আরও অপদস্থ হব, উনার তো কিছুই গায়ে লাগবে না। তাই চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।
ওপারে গিয়ে নৌকো থেকে নেমে আমরা কিছুক্ষন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্য সব যাত্রীরা চলে যাবার পর আমরা ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম। কোনও কথাবার্তা নেই, চুপচাপ হেঁটে চলেছি দুজনে। রুপন চলতে চলতে বারবার একা একা হাসছিল। আমি বললাম ‘তোর এত হাসি পাচ্ছে কেন ?’ সে বলল ‘আজ মাঝি যা খাতির করলেন সেই কথা মনে পড়লেই হাসি পায়!’ আমি বললাম তবে তুই হাসতে থাক পাগলের মত। আমার তো মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে, কেন যে ঘাগরাছড়া আসতে গেলাম! এসব বলতে বলতেই গিয়ে পৌঁছলাম ঘাগরাছড়া পুজো মণ্ডপে। সেখানে কিছুক্ষন সময় বসে রইলাম। তারপর ফিরে আসার পথে বারবার একটা কথাই ভাবছিলাম যে, একবার তো মাঝি মান ইজ্জত খেয়েছে, আবার কি বলবে কি জানি! কিন্তু ঘাটে এসে দেখলাম এবার সেই মাঝি নেই, অন্য একজন মাঝি নৌকা চালাচ্ছেন। আমরা দুজনে নির্বিঘ্নে নদী পার হয়ে ফিরে এলাম। সেই বছর পুজোয় বারবার ঐ মাঝির কথাগুলোই মনে পড়ছিল।
শারদ স্মৃতি | পর্ব- ০২
দেবাশীষ দাস
ত্রিপুরা, ভারত