Breaking News
Home / Breaking News / কবি ময়ুরী মিত্র এর গল্প ” সুখ পাখি “

কবি ময়ুরী মিত্র এর গল্প ” সুখ পাখি “

সুখপাখি

এবার শহরে বেজায় শীত | রাতের বেলা ঠাণ্ডায় শরীরে ঝাঁকানি বোধ করি | বুড়ো হচ্ছি তো | শীতরাত্রে কেবলই মনে হয় , রাত যেন দুষ্ট বাচ্চার মত হাত পা ছুঁড়ছে ৷ বাচ্চাদের মতোই শিকনি মাখা নাকে লম্বা শ্বাস ফেলছে | এমনটা হলেই বরাবর দেখেছি , আমার খুকিবেলার সেই শীতবুড়োটা চলে আসে আমার স্মৃতির ডগায় |
শীতদাদু ৷ আমার ঠাকুরদার পণ্ডিত মশায় | মানে আপনি ধরে নিতে পারেন ঠাকুর্দারও ঠাকুরদা | কিন্তু যে সময় আমি তাঁকে দেখি ,আমার সেই খোকা চোখের ফুটিফুটি কালে মনে হয়েছিল ছাত্র মাস্টার বুঝি একই সময়ে এসেছেন এ ধরাতলে | পরস্পর হাত ধরে | অথচ দেখুন , হিসেবে একজন আরেকজনের চেয়ে অন্তত এক কি দুদশক বড় হবেন , এই ছিল স্বাভাবিক | একজন আরেকজনের আগুপিছু না হলে মাস্টার ছাত্র হবেনই বা কি করে | সেসময় কিন্তু মনে হত এঁরা আমার জোড়া ঠাকুরদা বা একই ঠাকুরদার দুটো পিঠ | একদেহের সামনে পিছে দুইখানা মুখ |
ঠাকুরদার sir কে কেন যে শীতদাদু বলতাম তা আজ স্পষ্ট মনে করতে পারি না | কারণ মাস্টারমশায়ের বয়স কিংবা স্ট্যাটাস সমঝে নিতে যে ধারালো জ্ঞানগম্মি লাগে তা তখন ছিল না | কেবল এটুকু মনে আছে ,পন্ডিতমশায়ের কাঠি কাঠি নীল শিরা দেখে কেমন এক শীত শীত ভাব গজাত মনে | অথচ হাতে লাঠি বা কাঁধে ঝুলি — মানে গ্রামের মাস্টারমশায়দের যে ধরনের মলিন ও নিরুপায় বেশভূষা ঠিক করে রেখেছে বাংলা উপন্যাস , তার লেশমাত্তরও ছিল না শীতদাদুর | কান্না ফাননা বা ক্লান্তি টানতির no বালাই ৷
মোষকালো পাম্পসুতে খচমচ করে আসতেন আমার ঠাকুরদার কাছে | খুব একটা unsmart লাগত না কিন্তু ৷ বরং একটা তৃপ্তি থাকত তাঁর চলনে | দুপুরবেলায় তেলাল সর্ষে রঙের পেতলের থালায় ঢিবি ভাতের সঙ্গে অন্তত পাঁচ ছ রকম তরকারিপত্তর তাঁকে খেতে দিতেন আমার ঠাকুরদা | ঠাকুরদার দিকে একটুও না তাকিয়ে নিমেষে তা শেষ করতেন ঠাকুরদার পণ্ডিত | বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা ঐ ছোট বয়সেই মশায়ের ঐ বেলাজ খাওয়া দেখে কেমন কিরকির করত মনটা | blackboard এ চক ঘষটে গেলে যেমন অস্বস্তি জাগে -অমন | খালি মনে হতো এতো মন লাগিয়ে এতো পরিমানে এতো রকমে খেয়ে ইনি এবার করবেনটা কি ? আবার পণ্ডিতমশায়ে আমার মন লেগে যাওয়া তাঁর ঐ বিশেষ ধরনের চারুহীন খাওয়াটি দেখেই |
এবার আমি তখন কী করতাম , বলি ? শিকারি বিড়ালের মতো কাপ ধরে বসে আছি তো আছিই | ভাবছি , খেয়ে উঠে পণ্ডিত ঠিক কী গল্প বাঁধবেন আজ আমার জন্য ? এতো করে খেলেন যখন , নিশ্চয় আজ আমার জন্য বাঁধা হচ্ছে একটা অন্য গল্প | অন্য Hero বা অন্য Queen |
রোজ রোজ ক্ষুন্ন হতাম | রোজই তাঁর গল্পে সার বেঁধে দাঁড়াত দুনিয়ার যত সুখী মানুষ | just ভাবুন | গল্পে কোন দুখীই নেই |
প্রজাই নেই | শুধুই king কিংবা শুধুই Queen | আর তারা সব একধারসে বেধড়ক সুখী | রাগ আমার গনগনে হচ্ছে বুঝে মাঝে মাঝে কাহিনীতে variety আনার চেষ্টা করতেন শীতদাদু | young handsome কুমার বা কুমারীরাও গল্পে আসতেন মাঝে মাঝে | কিন্তু সব ঐ দুঃখবিলাস মেখে | বিরক্ত হয়ে ভাবতাম , এক পলা সর্ষের তেলও কি ঘষা যায় না এ শালার সুখে ভরা রাজা রানীর রসভরা চোখে? ঢাউস সুখে নাহয় একটু পড়ুক দুখু মিয়ার পানিজল | হত না | বৃদ্ধটি যেন তরুণ জলহংসের ক্ষিপ্রতায় পাশ কাটিয়ে যেতেন জগতের যত দুঃখগুলোকে |
একঢালা সুখের গপ্পে দ্রুত ঘুমে ঢুলতাম আমি। গল্প শেষ হত একসময় ৷ ঠাকুরদার কাছ থেকে সামান্য পথখরচ আর মাসখরচটুকু নিয়ে এবার যে পণ্ডিতকে ফিরতে হবে ঘরে ৷ সেখানে তাঁর রোগে ভোগা মেয়ে ৷ পণ্ডিত হেসে বলতেন —ও আমার শুকনো শাকের গোছা ৷ ঠাকুরদার পণ্ডিতমশায়ের গল্পটা এখানেই শেষ ৷
তারপর বড় হয়েছি আমি ৷ হারিয়ে গেছেন ছেলেবেলার সুখী পণ্ডিত৷ কখন কীভাবে জানি না | –বহুকাল বাদে একবার শীতের সমুদ্দুর দেখতে গিয়েছিলাম | সে সমুদ্রে ঢেউ সরে গ্যাছে অনেকদূর ৷ আগে যেখানে সমুদ্র এখন সেখানে একটি পায়ে চলা বালু রাস্তা ৷ হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি তীরে কত আলো কত লোক কত হুল্লোড় ৷
পৌঁছে দেখি সামনে একটি বাতিঘর ৷
ওমা ! এমন করে কে নেভালে
বাতিঘরের আলোটা ?
বাতিঘর অনড় ৷
ঠিক করেছে নিরুত্তরে হাসবে ৷

Powered by themekiller.com