Breaking News
Home / Breaking News / কবি মোঃ মঈদুল ইসলাম এর ছোট গল্প ” শান্তি”

কবি মোঃ মঈদুল ইসলাম এর ছোট গল্প ” শান্তি”

শাস্তি
<<<<ছোটগল্প>>>>

একেকটা ছেলে থাকে তাদের মুখ দেখলেই কেমন লাগে-একটা চোর চোর ভাব। ছেলেটার চেহারা কেমন যেন বনকাঁঠালের মত এবড়ো খেবড়ো।
সে যাই হোক ছেলেটাকে ক’দিন থেকে দেখছি আমার সাথে দেখা হলেই অমনি আমাকে সালাম দিচ্ছে।
সে সকাল-বিকাল আামার বাড়ির সামনে দিয়ে যায়। কোথায় যায়, কেন যায় আমি কিছই জানিনা। দেখি সাইকেলে চেপে চলে যায়। আর তার সাইকেলের পেছনে কিসের একটা গাঠরি বাঁধা থাকে। কী থাকে তাতে বলতে পারব না।
আমি তার সালামের দায়সারা গোছের একটা উত্তর দিই-বেশির ভাগই ঘাড় দিয়ে। কেননা এই ধরণের ফকিন্নি টাইপের ছেলে আমাকে সালাম দেক এটা আমার ভালো লাগে না। আমার যেন প্রেস্টিজে বাধে। লোকেরা দেখলে কী ভাববে তার ঠিক আছে? আমার সাথে এই ভাবে সালাম কালাম করা দেখে লোকেরা হয়তো ভাববে আমিও ঐ লেবেলেরই মাল। তাই ছেলেটা আমাকে সালাম দিলেই আমি চিন্তাই পড়ে যাই। তখন চট করে আশপাশটা একটু দেখে নিই-তারপর ঐ ঘাড় বাঁকিয়েই উত্তরটা দিই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে এটুকুতেই তার মুখটা বেশ খুশি খুশি হয়ে ওঠে।
***
বৃন্দাবনপুরের মোড়ে আমি নুতন কাপড়ের দোকান দিয়েছি। একদিন দুপুর বেলায় হঠাৎ দেখছি ঐ ছেলেটা আমার দোকানে এসে হাজির। সে আবার সালাম দিয়েই আমার দোকানে প্রবেশ করল।
তাকে দেখা মাত্র আমার মনের মধ্যে কেমন ধরণের একটা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এসে গেল। এই ছোকরা কোনো বদ মতলবে আসে নি তো-মিষ্টি কথা বলে শুরু করে শেষে হয়তো বাকী চাইবে।
-‘ভাইজান আমাকে একটা ভালো দেখে বোরকা দেখান তো।’
আমি একটা বোরকা বের করে দেখালাম। সে সেটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে দেখে বলল-‘ভাইজান এর থেকে একটু ভালো হবে না।’
-‘হ্যা হবে- এই যে এটা আবায়া বোরকা।– এর দাম কিন্তু বেড়ে গেছে।’
সে চুপচাপ এবার আমার হাত থেকে আবায়া বোরকাটা হাতে নিয়ে আবার নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। তারপর আবার বলল-‘ভাইজান এর থেকে আরও একটু ভালো হলে ভালো হত!’
-‘এর থেকে ভালো? ও আচ্ছা ঠিক আছে- দিচ্ছি কিন্তু দাম বেশি পড়ে যাবে-এক দাম তিন হাজার টাকা।’ একথা বলে একটি সাধারণ টাইপের কমা বোরকা তাকে দেখালাম।
সে বলল-‘কিছু কমসম হবে না?’
-‘না হবে না- কেননা এটা এ্যালেক্সা কাপড়ের দামি মাল- কমানো যাবে না-বুঝলে।’
ছেলেটি কোনো কথা না বলে পুরো তিন হাজার টাকাই আমার হাতে দিয়ে দিল।
তারপর সে দোকান থেকে নেমে যাওয়ার সময় আমার দিকে মুতাওয়াজ্জা হয়ে আবার সালাম দিল।
আমি এবার তাকে স্বতস্ফুর্তভাবে একেবারে উত্তম রুপে তার সালামের জওয়াব দিলাম। দেখছেন তো টাকা মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়।
পরক্ষণেই কী মনে করে নিজেই নিজের আত্মসমালোচনা করতে গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বুকটা আমার ধকধক করে উঠল। এই আমি হুজুর হয়েছি! আমি একটা আলেম! ছেলেটার কী দোষ আমি তাও জানিনা। অথচ তার মুখ দেখেই তার প্রতি বিনা কারণে সেই কবে থেকে আমি শুরু করেছি অবজ্ঞা-অবহেলা তাচ্ছিল্ল। তার মুখের আদল দেখতে ভালো না তো তাতে তার করণীয় কী আছে? তার চেহারা তো সে নিজে থেকে বানায় নি।
আমাকে এখন সব থেকে এজন্য খারাপ লাগছে যে, সে যখন বারবার বলছিল, ভাইজান এর থেকে আর একটু ভালো হলে ভালো হত। তখন আমি একটা একেবারে নরমাল কাপড়ের বোরখাকে অ্যালেক্সা কাপড় বলে তার কাছে দাম আদায় করলাম তিন হাজার টাকা-অথচ সেটা আমার কেনা মাত্র আটশ’ টাকায়। পুরো বাইশশ’ টাকাই বেশি দাম নিয়েছি। ব্যবসা হালাল বললেই হল? ব্যাপারটা এত সহজ নয়–ব্যবসা করে হালাল রুজি করাই বরং বেশি কঠিন কাজ। এমনি কী হাদিসে বলা হয়েছে ‘একজন সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিনে নবী, রসূল, সিদ্দিক ও শুহাদাদের দলভুক্ত হবে।’ এ কী কম বড়ো মর্যাদার কথা!!! সুবহানাল্লাহ্ সুবহানাল্লাহ্ ।
ছেলেটার জন্যে মনটা আমার খা খা করতে লাগল। ছেলেটাকে আমি বিনা কারণে এই রকম হিংসা ও বিদ্বেষ কেন দেখাতে গেলাম। নিজেকে অপরাধী হিসাবে নিজের বিবেকের কাছে ধরা খেয়ে এখন আমি একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না।
ভাবলাম তার সাথে তো প্রায় দিন দেখা হয়ই- এর পরে দেখা হলে কোনো না কোনো বাহানায় তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো-নিজের ভুল স্বীকার করে নেব। আর তার কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি টাকা তাকে ফিরিয়ে দিবো।
কিন্তু কী যে ব্যাপার, পাঁচ-ছ’দিন চলে গেল তার সাথে আর দেখাই হল না। এদিকে আমার বিবেকে দংশনের সেই দগ্ধানো ভাবটা আসতে আসতে উবে গেল কিছু দিনের মধ্যে। এ জগতে কার কথা কে ক’দিন মনে রাখে বলেন। আপন মা-বাবা মারা গেলেই দু’দিন কেঁদে-কেটে তিন দিনের দিন ভুলে যায় মানুষ। তাই আমিও তাকে একদম ভুলে গেলাম। আসলে ঐ ছেলেটাকে এভাবে ভুলে যাওয়ার মেন কারণ হল তার সাথে আমার মোটেও দেখা না হওয়া। যতদূর সম্ভব সে হয়তো আর এই এলাকাতেই থাকে না। আমার ধারণা ছেলেটা আমাদের অঞ্চলেরই কিন্তু ঠিক কোন গাঁয়ে বা পাড়াতে তার বাড়ি সেটা আমি জানিনা।
***
পাঁচ-ছ’ মাস পরের কথা। তখন রমজান মাস। বিকেল বেলা। আমি দুই ব্যাগ ভর্তি করে বিভিন্ন ফল-ফলারি, শাক-সব্জি কিনে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এদিকে হাঁট-বাজার করতে গিয়ে এখনো আমার আসরের নামাজ পড়া হয় নি। বাজারের মসজিদে পড়লে পড়া যায় , কিন্তু ভাবছি বাড়ি গিয়েই পড়বো । এমন সময় একটি শববাহী গাড়ি আমাদের কালুর মোড়ে থেমে আছে। সেখানে প্রচুর লোক। আমি যে মোটর সাইকেল চালিয়ে যাবো সে জো নেই। লোকেদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম –‘এখানে কী হয়েছে?’
-‘ও হয় নি তেমন কিছুই, একজন মারা গেছে।’
-‘এই গাড়িতে আছে নাকি?’
-‘হ্যা- কেরালায় কাজ করতো। রাজমিস্ত্রীর কাজ। ১৪ তলার উপর থেকে পড়ে মারা গেছে।’
-‘কোন পাড়ার ছেলে?’
-‘এই তো আপনার বাড়ি পার করে যে ছোট কালভার্টটা আছে-ঐটা পার করে হারুপাড়ায়- কেউ কেউ বলছে ছেলেটাকে নাকি মেরে ফেলেছে।’
-‘মারবে কেন তাকে? কারা মারবে?’ বললাম আমি।
-‘মারবে কেন? দেশের কিছু খোঁজ-খবর রাখেন? জানেন না দেশে ‘মোব লিঞ্চিং’ চলছে।’
শববাহী গাড়িটি এভাবে এই কালুর মোড়ে খুব অল্প সময়েই জন্যেই হয়তো থেমেছে। যাতে করে এখানকার লোকেরা কেরালা থেকে আগত সেই মৃত রাজমিস্ত্রীকে এক নজর দেখতে পায়। অনেকেই এক নজর দেখছে আর চলে যাচ্ছে। রাস্তার উপর গাড়ি দাঁড় করে রেখে মানুষের চলাচলের অসুবিধা ঘটিয়ে বেশিক্ষণ এটা করা যাবে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে। একের পর এক মানুষ আসতেই আছে। আরো যেন ভিড় হয়ে গেল। শেষে কী আর করবো-আমিও লাশটিকে দেখার জন্যে মুখ বাড়ালাম। আহারে! এ যে দেখছি সেই ছেলেটা -যার কাছে আমি আটশ’ টাকার বোরকা তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম- বাইশশ’ টাকায় বেশি। এখন বুঝতে পারছি ছেলেটা আসলে পেটের জ্বালায় তখন কেরালাই চলে গিয়েছিল রাজমিস্ত্রীর কাজে- তাই তার সাথে আমার আর দেখা হতো না! চোখ আমার দাঁড়িয়ে গেল! আমি একেবারে থ’ হয়ে গেলাম!!
কিন্তু তার মুখ এর আগে যেমন এবড়ো খেবড়ো মনে হতো আজকে কিন্তু মোটেও সেরকম লাগছে না। আমার সূরা ক্বিয়ামাহ’র ২২,২৩ নং আয়াতের কথা মনে পড়ে গেল। ‘وُجُوْهٌ يَّوْمَءِذٍ نَّاضِرَةٌ- اِلٰي رَبِّهَا نَاظِرَةٌ অর্থাৎ ‘সেদিন কিছু সংখ্যক লোকের চেহারা হবে একেবারে তরতাজা-হাস্যজ্জল। আর তারা তাদের রবের দিকেই তাকিয়ে থাকবে।’ এই আয়াতের সঙ্গে এই লাশের সিমটম যেন পুরোপুরি মিলে গেছে। তারপর আবার রমজান মাস। আমার তো মনে হচ্ছে আমি একটা জান্নাতি লাশ দেখলাম। কিন্তু তারপরেও কঠিন এক উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসলো- ভাবছি এবার আমার কী হবে? আমি তাকে যেভাবে অবজ্ঞা-অবহেলা করেছি- যেভাবে ঠকিয়েছি তার কী কোনো প্রতিবিধান আছে? আজ থেকে সারা জীবন দগ্ধে মরার শাস্তি আমার জন্যে অবধারিত হয়ে গেল- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

Powered by themekiller.com