Breaking News
Home / Breaking News / কবি জয়দেব মণ্ডল এর রম্য রচনা “বাজি”

কবি জয়দেব মণ্ডল এর রম্য রচনা “বাজি”

বাজি ( রম্যরচনা )
জয়দেব মণ্ডল

গোপাল আর কমল বাল্যবন্ধু। এক পাড়াতেই থাকে। এবছর গোপাল বিএ আর কমল বিএসসি থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়েছে। তবে একটা বিষয় হল, একসঙ্গে থাকলেও তারা দুজন চুম্বকের দুই বিপরীত মেরু। আলোচনায় কোন প্রসঙ্গে কথা হলে একজন যায় উত্তরে তো আরেকজন যায় দক্ষিণে। মজার বিষয় হল, তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হোক, ঝগড়াঝাটি হোক পরক্ষণেই তাদের উভয়কেই একসঙ্গেই দেখা যায়, খোসমেজাজেই দেখা যায়। তাদের বন্ধুত্বে কখনই ভাঁটা পড়েনি।
গত কালের ঘটনায় ধরা যাক। সন্ধ্যে হয় হয়। ফুটবল খেলা শেষ করে সবাই রেস্ট নিচ্ছে। আগামীকাল অর্থাৎ আজ রাতে তারা দুজন আর দীপু, সজল, মিহির দীঘা যাওয়ার কথা। তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। কী কী নিতে হবে? ঠিক কখন রওনা দেবে। গাড়ি কখন আসবে? ঠিক সময়ে গাড়ি আসবে তো! ওইসব ড্রাইভারদের কথার একেবারে দাম নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক সেই সময় মাঠের কোণের মন্দিরের মাইকে সন্ধ্যারতি শুরু। ফলে একটা কথাও আর শোনা যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে কমল বলেই ফেললো “ভণ্ডামীর আর শেষ নেই।”
সঙ্গে সঙ্গে গোপাল বললো,” ভণ্ডামী বলছিস কেন? এটা তো হিন্দু কালচার। সকাল সন্ধ্যে পুজো হিন্দু কালচারের একটা নিয়ম। তাছাড়া এটা দেবতাকে সন্তুষ্টি করার বিধি।”
কমল বলে, “রাখ তোর দেবতা। তা দেবতাকে সন্তুষ্ট করবে, করুক না। কে বারণ করেছে? মনে মনে করলেই পারে। চোঙা ফোকার কী দরকার আছে? এবিষয়ে মানুষের ডিস্টার্ব হয় না? বিজ্ঞানের যাবতীয় সুবিধা নেবে আর দেবতার গুণকীর্তন করবে। পারবি একদিন বিজ্ঞানের যাবতীয় সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে?”
‘না পারার কি আছে?’ গোপাল বলে।
‘তাহলে বাজি থাকলো। যদি পারিস, তবে দীঘা ট্যুরের যাবতীয় খরচ আমার। নইলে সব খরচ তোকেই দিতে হবে। কি ঠিক আছে?’ কমল বলে।
প্রত্যুত্তরে গোপাল বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে।’
ঠিক হল, আজ রাতে দীঘার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে প্রথমে তারা পথে কোন বড় ফাঁকা মাঠে নেমে পড়বে। সেখানে গোপাল কথামতো, সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত বিজ্ঞানের জিনিস ব্যবহার না করে থাকবে। তারপর তারা দীঘার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
*************
রাত সাড়ে দশটায় প্রতিদিনের মত গোপাল ঘুমাতে গেল। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়েও পড়লো।
ভোর সাড়ে পাঁচটা, গাড়ি এসে দাঁড়ালো একটা বিশাল মাঠের কাছে। একদিকে চাষের জমি। বেশির ভাগটাই ফাঁকা। অপরদিকে অনাবাদী জমি, রুক্ষ মাটি। সেই অনাবাদী জমির মাঝে মাঝে বাবলাগাছ আর কাঁটাঝোপের জঙ্গল। আর একটা বিশাল বটগাছ, পাশে একটা নালা। বর্ষায় হয়তো জল টইটম্বুর থাকে। এই চৈত্রে তার ছিটফোঁটা কয়েক জায়গায় এখনও বর্তমান আছে। আশেপাশে পাঁচ-সাত কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই।
”পারফেক্ট জায়গা। কি বলিস তোরা।” কমল বলে।
গোপাল বাদে বাকীরা সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘হানড্রেড পারসেন্ট পারফেক্ট।’
বটগাছের নীচে গরু- ছাগলের বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ। গোপাল তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। সে কোনো কথা না বলেই হন্ হন্ করে এগোতে থাকে। একে একে আমরা সবাই নেমে পড়ি। কিছুদূর গিয়ে কলাগাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা কলাপাতা আর কিছুটা তেলাকুচার লতা ছিঁড়ে নিয়ে আসে। তারপর আবার গাড়ির ভিতর ঢুকে যায়। ব্যাপার কী? আমরা সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি! ভাবছি! কিছুক্ষণের মধ্যে গোপাল ড্রেস চেঞ্জ করে আমাদের সামনে হাজির। দেখামাত্রই আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠি। কলাপাতা তেলাকুচা লতা দিয়ে কোমরে জড়ানো। দীপুটা একটু ফচকে ধরনের। টারজান এর মত বিকট আওয়াজ করে বললো, “স্যার, নিচে কেন গাছে উঠুন।” নাদুসনুদুস চেহারার গোপালকে আজ পর্যন্ত কেউ গাছে উঠতে দেখেনি।
গোপাল বলে, “ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
‘এই তোরা থামতো।’ আমি বলি, ‘দাঁড়িয়ে কেন স্যার বসুন।’
বসার জন্য গোপাল সামান্য ঝুকেছে আর অমনি পেছনের দিকে কলার পাতা গেল ছিঁড়ে। আবার উঠলো হাসির রোল।
ইতিমধ্যে ইয়ার্কি ফাজলামিতে দেখতে দেখতে ঘন্টা দুই কেটে গেছে। গোপাল ছাড়াই আমরা ব্রেকফাস্ট সারলাম। কেননা আমরা যা খাচ্ছি সবেতেই বিজ্ঞানের অবদান আছে।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি, মুখ চালু হতে দেরি নেই যে ভোজনরসিক গোপালের, সেই গোপাল আজ খাবারের থেকে দশ হাত দূরে।
মিহির ফোড়োন কেটে বলে, ‘কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি!’
সজল বলে, ‘হার স্বীকার করে নে। নাহলে পুরোটাই লসে রান করবি।’
এদিকে হয়েছে কি একটা দুটো করতে করতে বেশ কয়েকটা গরু ছাগল চরতে শুরু করেছে। ইয়ার্কি ফাজলামিতে আমাদের সেদিকে কোন হুস নেই। চরতে চরতে বেশ কয়েকটা গরু ছাগল আমাদের একেবারে কাছে চলে এসেছে। কলাপাতা খাবার লোভে বেশ কয়েকটা ছাগল গোপালের পিছু নিয়েছে। গোপাল হাতের কাছে যা কিছু পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে । বেগড়বাই ছাগলগুলো কিছুদূর যাচ্ছে পরক্ষণে আবার ফিরে আসছে। যেন একটা খেলা পেয়েছে। শেষমেস একটা ছোট্ট গাছে ওঠার বৃথা চেষ্টা করে গোপাল। নাদুসনুদুস গোপাল কিছুতেই গাছে উঠতে পারে না। এদিকে ছাগলের পাল তার কলার পাতা ছিঁড়ে খেতে শুরু করে। তা দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাবার জোগাড়।
না আ আ …
****************
গোপাল ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়।
বেশ বেলা হয়ে গেছে। গোপালের রাত থেকে ধুম জ্বর। পাশে মা তখন বসে জলপট্টি দিচ্ছিল কপালে। নিজের বিছানায় নিজেকে দেখে স্বস্তি ফিরে পায় গোপাল। এখনও তারা দীঘার উদ্দেশ্যে রওয়া হয়নি। সব স্বপ্ন। আজ রাতে যাওয়ার কথা। বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি। দীঘার ট্যুর ক্যানসেল।
”কি উলফাল বকছিস।” মা বলে।
গোপাল বলে, “ও কিছু না।”

Powered by themekiller.com